সুলতানি যুগে আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 10/01/2014 - 16:45

আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ (Development of The Regional Languages and Literature during the Sultanate Period) :

(১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (Bengali Languages and Literature) : সুলতানি ও মুঘল আমল ছিল বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণময় যুগ । বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস সম্ভবত চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । সমকালীন কবি বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী হলেও আদতে বাংলার কবি বলেই স্বীকৃত ছিলেন । বাংলার সুলতানরা রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করান । কৃত্তিবাস রামায়ণ লেখেন । হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করান । পরাগলের পুত্র চট্টগ্রামের শাসক ছুটি খান মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করবার জন্য শ্রীকর নন্দীকে নিযুক্ত করেছিলেন । কাশীরাম দাসও মহাভারত অনুবাদ করেন । বর্ধমানের কবি মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য’ রচনা করে ‘গুণরাজ খান' উপাধি লাভ করেন । তিনি ভাগবতেরও বঙ্গানুবাদ করেন । বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক বৃহস্পতি মিশ্রও এই যুগে আর্বিভূত হন । হুসেন শাহের আমলে বিপ্রদাস পিপলাই ও বিজয় গুপ্ত ‘মঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন । মানিক দত্তের ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও শঙ্করকিঙ্কর মিশ্রের ‘গৌরীমঙ্গল’ এই সময় রচিত হয়েছিল । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যকে কেন্দ্র করে যে জীবনী সাহিত্য রচনা হয়েছিল, তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটা গর্বের বিষয় । চৈতন্য জীবনীকারদের মধ্যে বৃন্দাবন দাস, গোবিন্দ দাস এবং জ্ঞানদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজের নাম উল্লেখযোগ্য । এই সময়ের আর একজন বিখ্যাত কবি হলেন মুকুন্দ দাস ।

(২) হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য (Hindi Languages and Literature) : হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের জনপ্রিয়তার জন্য সুফি-সন্তদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় । তাঁরা হিন্দি ভাষাতেই শ্রোতাদের সম্ভাষণ করতেন । পরে কবির, সুরদাসও মীরার ভজন লিখে হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করে গেছেন । আমির খসরুও হিন্দিতে তাঁর সাহিত্য কীর্তি রেখে গেছেন । জৌনপুরের বিখ্যাত সুফি সাধক মহম্মদ জয়সিও হিন্দি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন । তাঁর লেখা ‘পদ্মাবতী’ বিখ্যাত । দাদু ও গুরু নানকও কবিতা লিখতেন । তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ হিন্দি সাহিত্যের অমর সম্পদ ।

(৩) অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্য (Other Languages and Literature) : মারাঠি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে নামদেবের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । নানক ও তাঁর শিষ্যরা গুরুমুখি ভাষার উন্নতির জন্য সর্বদা উৎসাহ দেখাতেন । পশ্চিম ভারতে জৈন সাধকগণ প্রাচীন গুজরাটি ভাষাতে লেখা সমস্ত জৈনশাস্ত্র সংগ্রহ করে গুজরাটি ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসার নিদর্শন রাখেন । আসামের ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা শঙ্করদেব অহমিহা ভাষাকে জনপ্রিয় করে তোলেন । তিনি পুরাণের কাহিনি অবলম্বনে কয়েকটি একাঙ্ক নাটক রচনা করেন । পুরীতে থাকাকালীন শ্রীচৈতন্য তাঁর শিষ্যদের সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে ঊড়িয়া ভাষা ব্যবহারে উৎসাহ দিতেন । বিহারে মৈথিলি ভাষার উন্নতির পিছনে ভক্তিবাদ ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ছিল অনেকখানি ।

মুঘল যুগেও আঞ্চলিক সাহিত্যের উন্নতি অব্যাহত ছিল । এই সময় মারাঠি ভাষায় একনাথ, রামদাস ও তুকারাম, অহমিয়া সাহিত্যে মাধবদেব, গুজরাটি সাহিত্যে শ্রীধর, নরসিংহ মেহতা, আখো ইত্যাদি, ওড়িয়া সাহিত্যে উপেন্দ্র ভঞ্জ, কবিসুর্য বলদেব প্রভৃতি সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছিলেন । দক্ষিণ ভারতে তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও মালায়ালাম সাহিত্য সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল । চোল ও পাণ্ড্যদের পতনের পর অবশ্য তামিল সাহিত্যের গৌরবময় যুগের অবসান হয়েছিল । বিজয়নগর রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কন্নড়ি ভাষার প্রভূত উন্নতিসাধন হয়েছিল । বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমল ছিল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ । দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।

*****

Related Items

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ ও তার ফলাফল

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি বড়ো কারণ ছিল পুঁজির জোগান । এই পুঁজির অনেকটাই এসেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসাবাণিজ্য থেকে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুটি সমস্যা দেখা দেয় ...

ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

ভারত ইতিহাসে ইংরেজ শাসনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার । কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড অচিরেই রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল । আগে যেসব বহিরাগত জাতি ভারতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে ...

দেওয়ানি লাভ ও দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

বক্সারের যুদ্ধে ত্রিশক্তির পরাজয়ের পর প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ইংরেজদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এই অবস্থায় ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে বাংলায় ক্লাইভের পুনরাগমন ঘটে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের এলাহাবাদ চুক্তিতে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কারা ও এলাহাবাদ ছাড়া ...

বক্সারের যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, মুঙ্গের ও উদয়নালায় পরপর ছয়টি যুদ্ধে মিরকাশিম পরাজিত হন । এই অবস্থায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরকাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে আবার বাংলার মসনদে বসান । কিন্তু মিরকাশিম হাল না ছেড়ে মুঘল সম্রাট শাহ আলম ...

মির কাশিম (Mir Kasim)

কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ এবং বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টোগ্রামের জমিদারি প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মিরকাশিম বাংলার মসনদ লাভ করেন । ইংরেজদের সাহায্যে বাংলার মসনদ দখল করলেও তিনি ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন । অহেতুক ইংরেজ বিরোধিতা তাঁর ...