সুফি আন্দোলন (Sufi Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 09/25/2014 - 10:22

সুফি আন্দোলন (sufi Movement or Sufism) :

খ্রীস্টীয় নবম–দশম শতকে ইসলাম ধর্মের মধ্যে একটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । এই আন্দোলন ‘সুফি আন্দোলন’ নামে পরিচিত । যারা সুফ বা পশমের বস্ত্র পরিধান করে তাদেরকেই সুফি বলা হয় । অর্থাৎ, সুফি কথাটির সঙ্গে ‘সাফা’ বা পবিত্রতা ও ‘সাফ’ বা অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই । সুফি মতাদর্শের উদ্ভবের পিছনে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে । এই তত্ত্বগুলির মধ্যেও আবার স্ববিরোধ আছে । সুফি মতাদর্শের ওপর যোগ, উপনিষদ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল । সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভোগবিলাস ও ঐশ্বর্যের উন্মাদনা এবং তাদের নৈতিক অবক্ষয় ও অধঃপতন লক্ষ্য করে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান মর্মাহত হন । তাঁরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে মনস্থ করেন । এঁদের অনেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন । এঁদের চিন্তাধারা গোঁড়া মুসলমানদের মনঃপূত হয় নি । তাঁরা সুফিদের ইসলাম বিরোধী বলে মনে করেন । ফলে সুফিরা ক্রমশ নিজেদের সরিয়ে নিয়ে নির্জনে ধর্মচর্চা করতে শুরু করেন । এঁরা একজন পীর বা শেখের অধীনে একটি ধর্ম সংগঠন গড়ে তোলেন । সংগঠনের সদস্যদের বলা হত ফকির বা দরবেশ । এঁরা ঈশ্বরে একাত্ম হয়ে নিভৃতে ধর্ম সাধনা করতেন ।

সুফিদের মূলতত্ত্ব : সুফিরা মনে করতেন প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরপ্রাপ্তির একমাত্র পথ । এর জন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য নয় । তাঁদের মতে, ত্যাগ ও বৈরাগ্যই হল মুক্তির একমাত্র পথ । আসক্তি থেকে আসে পাপ এবং পাপের অর্থ ক্লেশ । আত্মার শুদ্ধিকরণের জন্য সাধনা ও ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করতে হবে । সর্বধর্মসমন্বয়, জীবে প্রেম ও সম্প্রীতি ছিল সুফিদের আদর্শ । ভারতবর্ষে সুফিরা ইসলামের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন । তাঁরা মনে করতেন, উলেমারা কোরানের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা করছেন এবং ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাছেন । উলেমারাও সুফিদের উদার আদর্শবাদ সহ্য করতে পারতেন না । সুফিরা কিন্তু কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেন নি । বরং তাঁরা আশা করতেন একদিন সেইদিন আসবে, যেদিন আল্লাহ স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন ।

বিভিন্ন সুফি সম্প্রদায় : ভারতবর্ষে সুফিদের প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় প্রভাবশালী ছিল— দিল্লী ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি;  সিন্ধু, পাঞ্জাব ও মুলতানে সুরাবর্দি এবং বিহারে ফিরদৌসি

(১) চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনউদ্দিন চিশতি । তিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন ও আজমিরে বসবাস করতেন । চিশতি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নাম সর্বপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । বিখ্যাত কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন । হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন ।

(২) সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় প্রভাবশালী ছিলেন । এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগরি ছিলেন প্রধান । এই সম্প্রদায়ের সাধকেরা চিশতিদের মতো দারিদ্র ও কৃচ্ছ সাধনের জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না । সন্ন্যাসীর জীবনও এদের লক্ষ্য ছিল না । এঁরা রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় উচ্চপদ গ্রহণ করতেন ।

সুফিদের প্রভাব : সুফিদের ধার্মিক ও অনাড়ম্বর জীবন, ঈশ্বর ভক্তি এবং নির্জনে সন্ন্যাসীর জীবনাদর্শ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল । ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মগত ব্যবধান কিছুটা লুপ্ত করতে এরা সক্ষম হয়েছিল । ইসলামের সাম্যের আদর্শে উলেমাদের চেয়ে সুফিরা বেশী জোর দিতেন বলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত কৃষক ও কারিগরেরা সুফিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল । কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা সমাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতেন বলে সমাজে তাঁদের কোন প্রভাব পড়েনি ।

সুফিবাদ ও ভক্তিবাদের মিল ও অমিল : সুফি মতবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই মিল ছিল ।

(১) ঈশ্বরের আত্মনিবেদন ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন উভয় আদর্শেই স্বীকৃত ছিল ।

(২) উভয় সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করত যে গুরু অথবা পিরের সাহচর্য আত্মার মুক্তির পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক ।

এই মিলের পাশাপাশি কিছু অমিলও এদের মধ্যে ছিল ।

(১) সুফিদের ‘মিস্টিক’ বা মরমিয়া আদর্শ ভক্তিবাদী সাধকদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার করতে পারে নি ।

(২) ভক্তিবাদী সাধকেরা নিজেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন নি । বরং তারা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাঁদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ।

*****

Related Items

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক যুগের কী সম্পর্ক ছিল, তা বলা কঠিন। অনেকেই মনে করেন আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণকর্তা । বিষয়টি বিতর্কিত । কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে তফাত এত বেশি যে, দুটি সভ্যতা একই জাতি সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয় না । স্যার জন মার্শাল মনে করেন ...

সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক

সিন্ধু জনগণ কূপমন্ডূক ছিল না । সমকালীন অন্যান্য সভ্যতা মিশর, ব্যাবিলন ও সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু জনগণের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । সিন্ধু ও সুমেরীয় উভয় সভ্যতাই উন্নত নাগরিক জীবন ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বাক্ষর বহন করে । উভয় অঞ্চলের মানুষ ...

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilisation)

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন ...

ধাতুর আবিষ্কার ও তাম্রযুগ

নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর ...

মেহেরগড় সভ্যতা (Mehrgarh Civilisation)

হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন । সভ্যতার বৈশিষ্ঠ, মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব ...