মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা - বাবর

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 09/07/2014 - 07:49

মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা - বাবর (Founder of Mughal Rule : Babur) :

ভারতে রাজ্য স্থাপন পরিকল্পনা সফল করতে বাবরকে একের পর এক নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয় । তিনটি প্রধান যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করার পর বাবরের স্বপ্ন সফল হয় । এই তিনটি যুদ্ধ হল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ ও ঘর্ঘরা যুদ্ধ ।

(ক) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (The first battle of Panipat) : বাবরের ভারত আক্রমণের প্রথম সুযোগ আসে যখন ইব্রাহিম লোদির বিক্ষুব্ধ একটি গোষ্ঠী ইব্রাহিম লোদিকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে বাবরকে আমন্ত্রণ জানান । এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাবর প্রথমে লাহোর অধিকার করেন । এরপর তিনি পাঞ্জাব অধিকার করে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । এই যুদ্ধে বাবরের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইব্রাহিম লোদির বাহিনী অনেক বড় হলেও ইব্রাহিম লোদি এই যুদ্ধে পরাস্ত হন । বাবরের সামরিক দক্ষতা ও শৌর্যবীর্যের প্রমাণ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ । কিন্তু এই যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর দ্বারা বাবরের ভারত বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি ।

(খ) খানুয়ার যুদ্ধ (Battle of Khanua) : আফগান সামরিক নেতারা ও রাজপুতবীর মহারানা সঙ্গ (রাণা সংগ্রাম সিংহ) ছিলেন বাবরের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান অন্তরায় । পানিপথের যুদ্ধের পর রানা সঙ্গের সাথে বাবরের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য । রানা সঙ্গ ইব্রাহিম লোদীর চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিলেন । কিছু কিছু আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন । এই বিপদের দিনেও কিন্তু সমস্ত আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে হাত মেলান নি । ১৫২৭ সালে খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের চরম পরাজয় ঘটে । খানুয়ার যুদ্ধ পানিপথের যুদ্ধের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এই রাজপুতরা । সুতরাং তাদের পরাজয়ের ফলে বাবরের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায় । তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয় । ইতিহাসবিদ রশব্রুক উইলিয়ামস মনে করেন যে, বাবর খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভ না করলে তাঁর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ সম্পূর্ণ নিষ্ফল হত ।

(গ) ঘর্ঘরার যুদ্ধ (Battle of Ghaghra) : বাবর কনৌজ, বারাণসী ও এলাহাবাদ অধিকার করে বিহারের সীমান্তে উপস্থিত হন । এরপর বাবর আফগান দলপতিদের দমন করতে মনস্থ করেন । বাংলা ও বিহারের আফগান দলপতিদের শায়েস্তা করতে তিনি ঘর্ঘরা ও গঙ্গানদীর সঙ্গমের কাছে একটি প্রান্তরে মিলিত হন । এই অবস্থায় বিহারের শের খাঁ, জৌনপুরের মামুদ লোদি ও বাংলার নসরৎ শাহ অন্যান্য আফগান শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করে বাবরের মুখোমুখি হন । বিহারের ঘর্ঘরা বা গোগরা নদীর তীরে বাবরের আক্রমণে আফগান শক্তি বিপর্যস্ত হয় । এই যুদ্ধ ঘর্ঘরার যুদ্ধ নামে পরিচিত । ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে মামুদ লোদির বাহিনী পরাস্ত হয় মামুদ লোদি পালিয়ে যান এবং বহু আফগান নেতা ও বাংলার শাসক নসরৎ শাহ বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন । ঘর্ঘরার যুদ্ধে আফগানদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে বাবর উত্তর ভারতের বিস্তৃত এলাকা দখল করেন । তাঁর সাম্রাজ্য অক্ষ নদী থেকে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত ও হিমালয় পর্বত থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় তাঁর কর্তৃত্বের বন্ধন ছিল খুব শিথিল । বাবর তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘ দিন ভোগ করতে পারেনি । এমনকি এই নব প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো শাসন ব্যবস্থাও তিনি চালু করতে পারেন নি । ঘর্ঘরার যুদ্ধের পরের বছর অর্থাৎ ১৫৩০ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে বাবরের মৃত্যু হয় ।

(ঘ) কৃতিত্ব ও মূল্যায়ন : আধুনিক ও সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরা বাবরকে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন । ভিনসেন্ট স্মিথ, হ্যাভেল, রসব্রুক উইলিয়ামস, ডেনিসন রস প্রমুখ ঐতিহাসিকরা উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁর প্রশংসা করেছেন । বাবরের সামরিক প্রতিভা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, বিদ্যা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ প্রভৃতি তাঁর চরিত্রের দিকগুলি প্রশংসা না করে উপায় নেই । এ কথা স্বীকার্য যে তিনি ভারতের ইতিহাসে কেবলমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের  প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেই স্মরণীয় হয়ে আছেন । শাসনতান্ত্রিক প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ তিনি বিশেষ পান নি । তাই বলা হয় তিনি যা করেছেন, তার চেয়ে তিনি যা করে যেতে পারেন নি, তার গুরুত্ব অধিক । অবশ্য যেটুকু সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, তা থেকে তাঁর শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার পরিচয় আমরা পাই না । কিন্তু চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের বংশধর হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে লুন্ঠনরাজ ও ধ্বংসের পরিবর্তে একটি সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয় । লেনপুন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, বাবর ছিলেন ভারত ও মধ্য এশিয়ার সংযোগকারী; সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও লুণ্ঠনকারী দস্যুদের মধ্যবর্তী তাঁর স্থান । তিনি ছিলেন তৈমুর ও আকবরের মধ্যবিন্দু ।

বিজেতা হিসাবে বাবরের নাম ভারতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে । সুদুর তুর্কিস্তান থেকে এসে নিজের প্রতিভা বলে তিনি ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । বাবরের চরিত্রে অসাধারন সামরিক প্রতিভা, ধৈর্য, স্থৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল । একদিকে তাঁর মানসিক বল, গভীর আত্মপ্রত্যয় ও অসাধারণ রণ নৈপুণ্য এবং অপরদিকে তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও তুর্কি, ফার্সি ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ইতিহাসের পাঠকদের মনে এক গভীর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।

(ঙ) বাবরের আত্মকথা : বাবরের আত্মকথা “তুজুক-ই-বাবরি” বা “বাবর নামা” তুর্কি ভাষায় লেখা । বইটি পড়লে জানা যায় বাবর ছিলেন ‘প্রকৃত প্রেমী’ । ভারতের বিভিন্ন গাছ, ফুল, ফল, পশু-পাখির বর্ণনা তিনি রেখে গেছেন । বইটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি নিজের দোষ ত্রুটি অত্যন্ত সততার সঙ্গে লিখে গেছেন । সহজ সরল ভাষায় সমসাময়িক কাল, স্থান ও পাত্রের বিবরণ তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । অসম সাহসী যোদ্ধার মধ্যে যে একটি কবি মন লুকিয়ে ছিল, তা এই বইখানি না পড়লে বোঝা যায় না ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...