মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য :
আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য : মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা পাঠান সহজ ছিল, অন্যদিকে তেমনই স্বল্প সুদে ঋণদানের ব্যবস্থাও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক হয়েছিল । এই সময় বিমা ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হত । মুঘল আমলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা স্তরবিন্যাস ছিল । পাইকারি ব্যবসায়ীদের বলা হত শেঠ বা বাহারা । আর খুচরো ব্যবসায়ীদের বলা হত বণিক বা ব্যাপারী । এছাড়া বনজারা নামে আর এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ছিল, যারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জিনিস পত্র বিক্রি করতো । হুন্ডির সাহায্যে পণ্য লেনদেন হতো এবং হুন্ডি ও অন্যান্য ব্যাংক-ব্যবসা জাতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব ছিল স্রফ বা সরাফদের হাতে । ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যথেষ্ট ধনী ছিল । দেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছাড়া স্থানীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় শহরগুলি গ্রামে উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল । প্রত্যেক এলাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনে বাজার বসত । সেখানে বেচা কেনা চলত । একে হাট বা পেঠ বলা হত । টেভার্নিয়ে এই ধরনের অসংখ্য হাটের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । তা-ছাড়া গ্রামে ও শহরে ফেরিওয়ালারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র গৃহস্থদের বাড়ি পৌঁচ্ছে দিত ।
অর্ন্তবাণিজ্য চলত দুভাবে— (১) অর্ন্তদেশীয় বাণিজ্য, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও (২) উপকূল ধরে সামুদ্রিক বাণিজ্য । অর্ন্তদেশীয় বাণিজ্য চলত স্থলপথ ও নদীপথ উভয় ভাবেই । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য দেশের যেসব রাজপথ ব্যবহৃত হত, তার সঙ্গে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য পথের যোগ ছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এই ধরনের বেশ কিছু রাস্তা ছিল । দক্ষিণ ভারতের রাজপথগুলি আবার উপকূলবর্তী শহরের সঙ্গে যুক্ত ছিল । প্রধান নদীপথ ছিল দুটি — (ক) মুলতান থেকে সিন্ধু নদ ধরে একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত ও (খ) গঙ্গা দিয়ে পাটনা হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত । গঙ্গার ধার ধরে বেশ কিছু বাণিজ্য শহর গড়ে উঠেছিল । সারা দেশে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, তাদের মধ্যে উত্তর ভারতে শ্রীপুর, সাতগাঁ, হুগলী, ঢাকা, কলকাতা, পাটনা, বারাণসী, লখনউ, আগ্রা, দিল্লি, মুলতান, লাহোর, কাবুল, কান্দাহার, আহমদাবাদ, সুরাট ও দক্ষিণ ভারতের বুরহানপুর, গোলকুণ্ডা ও মসুলিপত্তম বিখ্যাত । এইসব বাণিজ্য পথ ও শহর ধরে দেশের ঘাটতি অঞ্চলে জিনিসপত্র পাঠান হত । যেমন, বাংলা থেকে চাল, চিনি ও মাখন পাঠানো হত আগ্রায় । বাংলা ও ওড়িশা থেকে নিকৃষ্ট ধরনের চাল যেত মসুলিপত্তমে । বাংলায় আসত রাজস্থানের লবণ । পাটনা থেকে নদী পথে বাংলায় আসত গম ও উৎকৃষ্ট মানের চাল । মালব, রাজপুতানা ও উত্তর ভারত থেকে খাদ্যশস্য আসত গুজরাটে । তা-ছাড়া সমুদ্র উপকূল ধরে দাক্ষিণাত্য, গান্ডোয়ানা ও মালাবার থেকেও গুজরাটে খাদ্যশস্য আসত । অন্যদিকে গুজরাটের রেশম শিল্পের জন্য কাঁচামাল আসত বাংলা থেকে । তেমনই সুরাট, বুরহানপুরের তুলোর ওপর বাংলার বস্ত্রশিল্প নির্ভরশীল ছিল । ভারতের সর্বত্র বাংলার চিনির কদর ছিল । নদীপথে ওই চিনি পাঠান হত আগ্রায় এবং সমুদ্র পথে ভারতের সর্বত্র । অন্তর্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগ্রা শহরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ । এই শহরটি উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল । উপকূল ধরে যে বাণিজ্য চলত, তাতে দেখা যায় বিজয়নগর ও গোলকুণ্ডা থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বাংলা ও গুজরাটে পাঠানো হত । উপকূলীয় বাণিজ্যে চেট্টি ব্যবসায়ীদের আধিপত্য ছিল । পূর্ব উপকুলে বাংলা ও ওড়িশার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । বাংলা থেকে করমণ্ডল উপকূল হয়ে কোঙ্কন ও গুজরাটের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । বাংলার চালের ওপর অনেকেই নির্ভরশীল ছিল । বাংলার খাদ্য আসতে দেরি হলে খাদ্যাভাব দেখা দিত । ওড়িশা থেকে রপ্তানি হত তেল । উপকুলের বাণিজ্য কিন্তু সব সময় নিরাপদ ছিল না । জলদস্যুর উৎপাত ছিল ।
মুঘল যুগে যে সব বিদেশী বণিক ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য আসত, তাদের মধ্যে অনেকেই ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশ নিত । কোম্পানির আওতার বাহিরে তারা ব্যক্তিগত ভাবে এই বাণিজ্যে অংশ নিত । এই সব বিদেশি বণিক অনেক সমর নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত । আবার অনেক সময় তারা কোম্পানির জাহাজে দেশীয় বণিকদের মালপত্র বহন করত । এই সব দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মুঘল সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটত । সপ্তদশ শতকে এইসব বিরোধ তীব্র আকার ধারণ না করলেও পরবর্তী যুগে কিন্তু এই ধরনের বিরোধ এক তীব্র সংকটের সৃষ্টি করেছিল ।
*****
- 10969 views