মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 10/28/2014 - 11:19

মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প :

মুঘল যুগে বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানির ফলে ভারতে প্রচুর অর্থাগম হত । বিদেশ থেকে আমদানি করার মতো বিশেষ কিছু ছিল না । ফলে বিদেশের বহু মূল্যবান ধনরত্ন ভারতে এসে জমা হত । এই অবস্থা থেকে অনেকে মনে করেন যে, ভারত তখন শিল্পে খুব অগ্রগণ্য ছিল । আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন । এঁদের মতে, ভারতে উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সাবেকি ধরনের । প্রযুক্তি বিদ্যা ছিল মান্ধাতা আমলের । এই বিষয়ে ভারত তখন চিন বা ইংল্যান্ডের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল । খনিজ দ্রব্য ব্যবহারের পদ্ধতিও ভারতীয়দের অজানা ছিল । শিল্প উৎপাদন বাড়েনি । বরং তা এক জায়গায় স্থিতিশীল হয়ে গিয়েছিল ।

মুঘল আমলে গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প বা কুঠির শিল্প । কুঠির শিল্পকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথমত, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং দ্বিতীয়ত অকৃষি শিল্প ।

কৃষিনির্ভর শিল্প (Agriculture based Industry) : কৃষিনির্ভর শিল্পের মধ্যে পড়বে শর্করা শিল্প, তৈল, তামাক, নীল, মদ প্রভৃতি শিল্প ।

(১) আখ ও তালের রস থেকে বিভিন্ন ধরনের চিনি তৈরি হত । আবুল ফজল পাঁচ রকম চিনির কথা বলেছেন । চিনি শিল্পের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলা, আগ্রা ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকা এবং গোলকুণ্ডা । আরব, মেসোপটেমিয়া ও পারস্যে চিনি রপ্তানি হত ।

(২) বলদের সাহায্যে তৈলবীজ পাথরে পিসে তেল তৈরি হত । সিন্ধু, গুজরাট, গোলকুণ্ডা, মহীশূর, ওড়িশা ও বাংলায় এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল । রপ্তানির উদ্দেশ্যে মেদিনীপুরে এক ধরনের গন্ধ তেল তৈরি হত ।

(৩) তামাক শিল্পের কেন্দ্র ছিল বুরহানপুর, বেরার, করমণ্ডল উপকূল, বাংলা ও বিহার ।

(৪) পোস্ত গাছের ফুল থেকে আফিম তৈরি হত । মালব, বেরার, খান্দেশ, বারাণসী, বিহার, বাংলা এবং রাজপুতনায় আফিম চাষ হত । শুধু মাদক দ্রব্য হিসাবে ও ওষুধ হিসাবে আফিম -এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিন, পারস্য, এবং আরবে আফিম রপ্তানি করা হত ।

(৫) কাপড় রং ও উজ্জ্বল করতে আগ্রা, মসুলিপত্তম, ঢাকা, কাশিমবাজার, আমেদাবাদ প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রগুলিতে নীলের চাহিদা ছিল ।  ইউরোপের বাজারে নীলের চাহিদা খুব ছিল । ফলে নীলের ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক । নীলের চাষ হত বিয়ানা (আগ্রা), গুজরাত ও গোলকুণ্ডায় । পরে বাংলা ও বিহারে নীলের চাষ ছড়িয়ে পড়েছিল ।

(৬) তাল ও খেজুরের রস থেকে মদ তৈরী হত । ঔরঙ্গজেব ব্যতীত সমস্ত মুঘল সম্রাটই মদ্যপান করতেন । কিন্তু সরকারি ভাবে মদের উৎপাদন নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা কখনই মানা হত না ।

বস্ত্রবয়ন শিল্প (Textile Industry) : কৃষিজাত শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বস্ত্র বয়নশিল্প । প্রায় সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হত । গুজরাটে পাটন, খান্দেশে বুরহানপুর এবং উত্তর ভারতে জৌনপুর, বারাণসী ও পাটনা ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্পের প্রধান কেন্দ্র । বাংলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া । ঢাকার মসলিন বস্ত্র ছিল খুব বিখ্যাত । রেশম শিল্পের মূল কেন্দ্র ছিল ক্যাম্বে, সুরাট, আহমদাবাদ, পাটন, চাউল প্রভৃতি গুজরাটের বিভিন্ন শহর, পাটনা, বারাণসী, বাংলা, আগ্রার সন্নিকটে ভীতাপুর, লাহোর প্রভৃতি । পশম বা উলের জন্য বিখ্যাত ছিল কাবুল, কাশ্মীর ও পশ্চিম রাজস্থান । তবে ভারতের পশম খুব একটা উচ্চ মানের ছিল না । আকবরের উৎসাহে কাশ্মীরে শাল শিল্প এবং আগ্রা ও লাহোরে কার্পেট শিল্পের প্রসার ঘটেছিল । শণ ও পাটের তৈরি জিনিসও বহুল ব্যবহৃত হতো । ভারতের প্রায় সর্বত্র শণ উৎপন্ন হতো । বাংলায় হতো পাটের চাষ । পাট দিয়ে দড়ি, বস্তা বা থলে তৈরি হত । কাশিম বাজারের দড়ি ছিল বিখ্যাত ।

*****

Related Items

ইলতুৎমিস (Iltutmish)

দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইলতুৎমিস । তিনি ১২১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । কুতুবউদ্দিন তাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে ক্রয় করেন । পরে তাঁর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ও নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন । ...

কুতুবউদ্দিন আইবক (Qutb-ud-din Aibak)

১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ভারতের অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সাহায্য নিয়ে মহম্মদ ঘুরিকে পরাস্ত করেন । পরের বছর অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত নিহত করে দিল্লী ও আজমীর দখল করেন ...

সুলতানি আমল (Delhi Sultanate)

সুলতানি আমলে পর পর পাঁচটি রাজবংশ দিল্লির সিংহাসনে ক্ষমতাসীন ছিল । সেই পাঁচটি রাজবংশ হল - ইলবেরি তুর্কি বংশ বা দাসবংশ, খলজি বংশ, তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ, লোদী বংশ। সুলতানি আমলে বলপূর্বক ও হত্যা করে সিংহাসন দখল করা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা ...

মহম্মদ ঘুরি (Muhammad Ghori)

আফগানিস্তানের গজনী ও হিরাটের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ঘোর রাজ্য । সেই সময় উত্তর ভারতের হিন্দু রাজাদের মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না । এই সব হিন্দু রাজাদের মধ্যে আজমীর ও দিল্লির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহান ও কনৌজ-রাজ জয়্চাঁদ ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী ...

সুলতান মামুদ (Sultan Mahmud of Gazni)

মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু জয়ের ৩০০ বছর বাদে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গজনির সুলতান মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন । সুলতান মামুদ একজন লোভী, লুন্ঠনকারী, রূপেই পরিচিত । ভারতে রাজ্য স্থাপনের কোনো ইচ্ছা তার ছিল না । ইসলাম ধর্মের প্রসার ...