মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 10/30/2014 - 21:20

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ :

পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ : ১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সরাসরি সামুদ্রিক পথে যোগাযোগের সূত্রপাত হয় । এর আগে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগর হয়ে কিছুটা জলপথ ও কিছুটা স্থলপথ ধরে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য চলত । কিন্তু ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনের ফলে এই বাণিজ্য পথ ব্যাহত হয় । এই অবস্থায় ভাস্কো-দা-গামার আগমন ভারত-ইউরোপের বাণিজ্যে এক যুগান্তরের সৃষ্টি করে ।  

একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পর্তুগিজরা ভারতে এসেছিল । সেই উদ্দেশ্য হল বাণিজ্য, বিশেষত মশলা বাণিজ্য । স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় বণিকদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । কিন্তু ষোড়শ শতকে পর্তুগিজ ও মুসলিম উভয় বণিক গোষ্ঠীই নিজ নিজ প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিল । তবে পর্তুগিজরা লোহিত সাগর ও মালাবার উপকূলের মধ্যে চলাচলকারী মুসলিম বাণিজ্যপোত দেখলে তা আক্রমণ করে মুসলমানদের বাণিজ্য ধ্বংস করতে সচেষ্ট ছিল । এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক প্রাধান্য স্থাপনে তাদের প্রধান ভরসা ছিল শক্তিশালী নৌবহর । ১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দে তারা কোচিনে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন । এরপর তারা দিউ, গোয়া, মালাক্কা ও ওরমুজ দখল করে নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য বাড়াতে থাকে । পশ্চিম ভারত ছাড়া পর্তুগিজরা করমণ্ডল উপকূলে মাদ্রাজের কাছে সানটোম এবং বাংলার হুগলি ও চট্টোগ্রামে কুঠি নির্মাণ করে । পর্তুগিজ বণিকদের নীতি ছিল যেভাবে হোক, প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করেও দুর্গ বা ঘাঁটি নির্মাণের জন্য স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করা, শান্তিপূর্ণ পথ পরিত্যাগ করে জোর করে টাকা আদায় করে বা জলদস্যুতার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে প্রতিযোগিতায় কোণঠাসা করা । আরব সাগরে বাণিজ্য করবার জন্য ভারতীয় বণিকদের অর্থের বিনিময়ে পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুমতি পত্র আদায় করতে হত । স্থানীয় শাসকেরা পর্তুগিজদের এই অন্যায় দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন । ১৫৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিজাপুরের সুলতান এই অবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হন । এমনকি সুরাটের মুঘল কর্তৃপক্ষও এই ব্যবস্থা মেনে নেন । এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় বণিকরা পূর্ব আফ্রিকা, চিন ও জাপানের বাণিজ্যে পর্তুগিজদের কাছে হটে যেতে থাকে । এ সত্ত্বেও কিন্তু ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যে পর্তুগিজরা তাদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপন করতে পারে নি । ভারতীয় বণিকেরা অনেক সময় পথ পরিবর্তন করে পর্তুগিজদের এড়িয়ে নিজেদের ব্যবসাবাণিজ্য চালু রাখত । তা ছাড়া মুঘল সম্রাটরা বিদেশি বণিকদের ব্যবসাবাণিজ্যের কাজে আপত্তি না করলেও তারা যদি সম্রাটের ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপ করবার চেষ্টা করত বা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করত, সম্রাটরা তা বরদাস্ত করতেন না । পর্তুগিজদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । জাহাঙ্গিরের সময় পর্তুগিজরা একবার সুরাটের কাছে চারটি সরকারি জাহাজ দখল করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে পর্তুগিজদের দমন করেন । তাদের বেশ কিছু সুযোগসুবিধা কেড়ে নিয়েছিলেন । পরে অবশ্য পর্তুগিজরা ভুল বুঝতে পারায় সম্রাটের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়া হয় । শাহজাহানের আমলে পর্তুগিজরা বাংলায় নানা বেআইনি কাজকর্ম শুরু করলে তিনি তাদের শায়েস্তা করতে হুগলি ও চট্টগ্রাম দখল করেন । ষোড়শ শতকের শেষার্ধ থেকে পর্তুগিজদের পতন শুরু হয় । গোয়া, দমন ও  দিউতে অবশ্য তাদের আধিপত্য ও প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ ছিল ।

*****

Related Items

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঔরঙ্গজেবের আমল থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল । ঔরঙ্গজেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যের বিশালায়তন অব্যাহত ছিল । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিভূত হয় । মুঘল সাম্রাজ্যের ...

জায়গিরদারি সংকট ও আঞ্চলিক বিদ্রোহ

ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটলেও তাঁর সময় থেকেই পতনের প্রক্রিয়া সূচিত হয় । জায়গিরদারি সংকট ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই সংকট তীব্রতর হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের আমলে একটানা যুদ্ধ ও বিশেষত তাঁর ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি ...

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System)

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System) :

মনসবদারি প্রথা (Mansabdari System) : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল সামরিক শাসন । জনগণের সেখানে কোন ভূমিকা ছিল না । জনসমর্থন নয়, ভীতিই ছিল এই শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যদিও আগেই বলা হয়

মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ও সংহতি

আকবরই মুঘল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । রাষ্ট্রশাসনে আকবর সরকারের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের মঙ্গলের কথাও চিন্তা করতেন । তাঁর প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতীয় ও সুলতানি শাসনের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল । বিশেষত শের শাহ প্রবর্তিত শাসন ...

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (The Reign of Aurangzeb)

এক নাটকীয় ভ্রাতৃবিরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ঔরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন । ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের চরম বিস্তৃতি ঘটে । আবার তাঁর সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন প্রক্রিয়াও সূচিত হয় । তাঁর সময়ে রাজ্য জয়ের সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল । ...