বৈচিত্রের মাঝে ভারতের মূলগত ঐক্য

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 14:46

বৈচিত্রের মাঝে ভারতের মূলগত ঐক্য (Basic Concept of unity in diversity in India) :

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিশাল এই ভুখন্ডের তাপমাত্রা, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, জৈব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, মানবীয় বৈচিত্র্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য, ধর্মীয় বৈচিত্র্য প্রভৃতি অসাধারণ ভৌগলিক বৈচিত্র্য এবং ভাষা, ধর্ম তথা মানুষের জীবন যাত্রা ও রীতিনীতিতে নানান বিভিন্নতা থাকা সত্বেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতবাসীদের মধ্যে এক অতুলনীয় ঐক্যবোধ লক্ষ করেই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতীয় সভ্যতাকে 'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য' (Unity in the midst of diversity) বলে অভিহিত করেছেন ।   

(ক) ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical Unity) : অতি প্রাচীন কাল থেকেই অখন্ড ভারতের ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । বিষ্ণুপুরাণে সমস্ত ভারতবাসীকে ভারতের সন্ততি বলে অভিহিত করা হয়েছে ।         

(খ) রাজনৈতিক ঐক্য (Political Unity) : প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দু রাজারা একরাট, সম্রাট, বিরাট, রাজচক্রবর্তী প্রভৃতি উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ঐক্য স্থাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন । মোগল এবং ব্রিটিশ আমলেও ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা অনেকাংশে সাফল্য লাভ করেছিল ।

(গ) ধর্মীয় ঐক্য : যুগে যুগে ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্ম মতের উদ্ভব হয়েছে । আর এই বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যেই আদর্শগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় । প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই উদারতা, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, প্রভৃতি সদগুণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।

(ঘ) ভাষাগত ঐক্য : ভারতবর্ষের জনগণ ১৮টি প্রধান ও বহু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে । এইসব ভাষাগুলির মধ্যে এক অন্তর্নিহিত ঐক্যের সুর পরিলক্ষিত হয় । উত্তর ভারতের মূল ভাষা 'সংস্কৃত' ভাষা থেকে হিন্দি, বাংলা, অসমিয়া, মারাঠি, গুজরাটি প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে । আর দক্ষিণ ভারতের মূল ভাষা 'দ্রাবিড়' ভাষা থেকে তামিল, তেলেগু, প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব ঘটেছে ।

(ঙ) সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ঐতিহ্যের বন্ধন (Cultural Unity) : প্রাচীন যুগ থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রিক, পারসিক, শক, কুষান, পল্লব, হূন, পাঠান, মোগল প্রভৃতি জাতি বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল । কালক্রমে তাদের সংস্কৃতি ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যায় এবং পরস্পরের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে । এই সম্মন্ধে গান্ধীজি বলেছেন "ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে হিন্দু, ইসলাম, বা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নয়— এটি সমস্ত সংস্কৃতির মিশ্রণ ।" 

(চ) সর্বভারতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ : ব্রিটিশ শাসনকালে সমগ্র ভারতবর্ষে একটি অখন্ড ও এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় । রেলপথ ও বিভিন্ন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন । ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতবর্ষের 'জাতীয় পতাকা', 'জাতীয় সংগীত', এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে । বর্তমানকালে বিদেশি আক্রমণ, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রভৃতি কারণে কখনো কখনো সাময়িক অশান্তির পরিবেশ তৈরি হলেও ভারতের সনাতন ঐক্যের ধারাকে বিনিষ্ট করতে পারেনি । এই প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন "ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা" ।
*****

Related Items

হুমায়ুন ও মুঘল আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা

বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন ১৫৩০ সালে পিতার সিংহাসন আরোহণ করেন । কিন্তু তিনি যে জটিল সমস্যা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তা মোকাবিলা করার যোগ্যতা তাঁর ছিল না । দিল্লির শিশু রাষ্ট্রের ভিত ছিল খুবই দুর্বল । তখনও কোনো শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি । আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না । ...

মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা - বাবর

ভারতে রাজ্য স্থাপন পরিকল্পনা সফল করতে বাবরকে একের পর এক নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয় । তিনটি প্রধান যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করার পর বাবরের স্বপ্ন সফল হয় । এই তিনটি যুদ্ধ হল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ ও ঘর্ঘরা যুদ্ধ । পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ...

মুঘলদের উদ্ভব ও মুঘল সাম্রাজ্য

১৫২৬ সাল থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের মুল বিষয়বস্তু মুঘল-আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা । প্রথম পানিপথের যুদ্ধে যার সূচনা, দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তার পরিসমাপ্তি । প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন । ...

দিল্লি সুলতানির পতনের কারণ

দিল্লী সুলতানের পতন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় । জন্মলগ্ন থেকেই দিল্লি সুলতানির জীবনীশক্তি ছিল ক্ষীণ । আগাগোড়াই দিল্লি সুলতানির ভিত্তি ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত । দিল্লি সুলতানির কাঠামো ছিল স্বৈরতন্ত্র দিয়ে গড়া, যা দাঁড়িয়েছিল (আলাউদ্দিন এবং মহম্মদ বিন তুঘলকের সময় ছাড়া ) ...

সৈয়দ ও লোদি বংশ

তৈমুর দেশে ফিরে যাওয়ার আগে খিজির খান নামে একজন ব্যক্তিকে দিল্লি, মুলতান এবং দীপালপুরের শাসন ভার দিয়ে যান । এই খিজির খান তুঘলক বংশকে উচ্ছেদ করে সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের চারজন সুলতান ১৪১৪ থেকে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ...