বিদেশি আগমন ও হিন্দু সমাজে গতিশীলতা

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 08:54

বিদেশি আগমন ও হিন্দু সমাজে গতিশীলতা :

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে ব্যাকট্রীয়, গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ ও আরও পরে হুন প্রভৃতি বিদেশি জাতির আগমনের ফলে ভারতীয় সমাজে তার প্রভাব পড়ে । এইসব বিদেশির মধ্যে অনেকেই ভারতে থেকে যান, বিবাহ করেন এবং ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভুত হয়ে যান । শক, হুন দল ক্রমশ ভারতীয় আত্মায় মিশে হয়ে যায় । এদের মধ্যে অনেকেই পরে ভারতীয় নাম ও ধর্ম গ্রহণ করেন । শকনেতা রুদ্রদামন বা কুষাণ রাজা বাসুদেব তার জ্বলন্ত প্রমাণ । এঁদের রাজধানীকে কেন্দ্র করে এক ধরনের মিশ্র সমাজ ও সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে । জাতিভেদ শাসিত ভারতীয় সমাজে এঁদের মিলন সহজসাধ্য হয়নি । ক্রমশ জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা হ্রাস পাওয়ায় এঁরা ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হতে থাকেন । হিন্দু ধর্মে সহজে ঠাঁই না হওয়ায় এঁরা অনেকেই যেমন— কনিষ্ক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন । গুপ্ত যুগে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অভ্যুত্থানের ফলে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করা হত । এর ফলে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ কমতে থাকে । উপজাতিদের দেবদেবী ও বিদেশিদের ধর্মীও প্রথাও গৃহীত হতে থাকে । এইভাবে আদান প্রদানের মাধ্যমে হিন্দুসমাজ গতিশীল হয়ে উঠতে থাকে ।

বিদেশিদের দৃষ্টিতে মৌর্য ও গুপ্ত যুগ :

মৌর্য যুগে গ্রিক পর্যটক মাগাস্থিনিস ও গুপ্ত যুগে চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে ভারতীয় জনগণের সমাজজীবন সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় । মৌর্য যুগে মানুষ বিলাসী এবং ঐশ্বর্যশালী ছিল । তারা সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করত । সমাজে চুরি ডাকাতি কদাচিৎ ঘটত । মানুষ মিথ্যা কথা প্রায় বলতই না এবং পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করত । সাধারণ মানুষ লিখতে পড়তে জানত না এবং সহজ ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করত । ভারতীয় জীবন সম্পর্কে গ্রিক লেখকদের অবশ্য এই প্রশংসায় অতিশয়োক্তি থাকতে পারে । ফা-হিয়েনও বলেছেন যে, ভারতবাসী সুখী ও সমৃদ্ধিশালী ছিল । জিনিসপত্রের দাম কম ছিল এবং তারা স্বচ্ছন্দে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমন করতে পারত । বণিক সম্প্রদায় অত্যন্ত বিত্তশালী ছিল এবং বিদ্যালয়, মন্দির, হাসপাতাল, মঠ প্রভৃতি নির্মাণে প্রচুর অর্থ দান করত । পাটলিপুত্রের বৌদ্ধ মঠ ছিল বিখ্যাত এবং শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে এর খুব নাম ছিল । সংস্কৃত সাহিত্য থেকে জানা যায় গুপ্ত যুগের মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাস করত । কাক এবং শিয়ালের ডাক ছিল অশুভ লক্ষণ । দুর্ভাগ্য এড়ানোর জন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা ছিল । গণৎকার ও জ্যোতিষীদের বাজার ছিল বেশ রমরমা । গুপ্তযুগে পূজাপার্বণে জাঁকজমক, নাচগান, খাওয়াদাওয়া প্রভৃতি আমোদপ্রমোদের ঢালাও আয়োজন থাকত এবং প্রত্যেকে এইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিত । এই ধরনের উৎসবের মধ্যে ‘বসন্ত উৎসব’ ছিল খুবই জনপ্রিয় ।

বিদেশিদের দৃষ্টিতে গুপ্ত পরবর্তীযুগ —

হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতকে ভারতবর্ষে আসেন । তিনি বহুদিন ভারতে ছিলেন । মেগাস্থিনিসের মতো তিনিও ভারতবাসীর চরিত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন । ভারতীয়রা কিছুটা চঞ্চলমস্তিষ্ক, সৎ, এবং তারা কখনও কথার খেলাপ করত না বা কাউকে ঠকাত না । তারা মনে করত অন্যায় করলে এ জীবনে শাস্তি না পেলেও পরজন্মে তা অবশ্যই পেতে হবে । দক্ষিণ ভারতের মানুষ যুদ্ধপ্রিয় ছিল । তারা যেমন দয়ালু ছিল, তেমন নিষ্ঠুরও ছিল । গুপ্ত পরবর্তী যুগে মানুষের জীবন ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে পড়েছিল । তারা অন্ধের মতো শাস্ত্রের বিধান মেনে চলত । এই সময়ে জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত কঠোর আকার ধারণ করেছিল এমনকি একত্র আহার, বিবাহ, এবং স্পর্শ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়েছিল । কিন্তু তখনও মানুষের জীবনে আনন্দ ছিল । খেলাধূলা, উসব, খাওয়াদাওয়া, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রভৃতি লেগেই থাকত । কুস্তি ও শিকার ছিল অবসর বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম । এই সময় সামাজিক জীবনে একটি অবক্ষয় দেখা গিয়েছিল । মানুষ ক্রমশ কূপমন্ডুক হয়ে পড়ছিল । বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের সংযোগ ছিল না । একাদশ শতকের আরব পর্যটক আল বিরুনি তাঁর গ্রন্থ ‘তহক্‌ক-ই—হিন্দ’ -এ ভারতীয়দের এই সামাজিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন । ভারতীয়দের আগ্রহের অভাব, নিজেদের সম্পর্কে অহেতুক উচ্চ ধারণা, জাতিভেদ প্রথা, কূপমন্ডুক মনোভাব, গোঁড়া ও গর্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর চোখে পড়েছিল ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প

মুঘল আমলে গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প বা কুঠির শিল্প । কুঠির শিল্পকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথমত, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং দ্বিতীয়ত অকৃষি শিল্প । কৃষিনির্ভর শিল্পের মধ্যে পড়বে শর্করা শিল্প, তৈল, তামাক, নীল, মদ প্রভৃতি শিল্প । ...

সুলতানি ও মুঘল আমলের চিত্রকলা

একটি সময় ছিল যখন মনে করা হত সুলতানি আমলে চিত্রকলার কোনো চর্চা হত না । ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল । বর্তমানে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে । আসলে ভারতে ইসলামের আর্বিভাবের ফলে যে সমন্বয়ী প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছিল, তা ভারতের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে ...

মুঘল যুগের স্থাপত্য

স্থাপত্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে মুঘল যুগের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । নির্মাতা হিসাবে মুঘল সম্রাটদের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া । এই যুগের স্থাপত্য ভারতীয় ও পারস্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল । মুঘল স্থাপত্যরীতির সুচনা হয় আকবরের সময়ে ...

সুলতানি যুগের স্থাপত্য

দিল্লির কুতুবমিনার (Qutb Minar) হল এয়োদশ শতকের মুসলিম স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন । সুফি সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল । কুতুবমিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করেন কুতুবউদ্দিন আইবক এবং সম্পূর্ণ হয় ইলতুৎমিসের আমলে । ...

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ :

ফার্গুসনের মতে, সুলতানি স্থাপত্যের প্রকৃতি ছিল ইন্দো-স্যারাসিনিক (Indo-Saracenic) বা পাঠান । আবার হ্যাভেলের মতে, এই শিল্পরীতির ‘দেহ ও আত্মা’ ছিল ভারতীয় । আসলে সুলতানি যুগের স্থাপত্য প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরী