প্রাচীন ভারতের বিবাহ প্রথা

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 23:01

প্রাচীন ভারতের বিবাহ প্রথা :

বিবাহ প্রথা : ধর্মসূত্র গ্রন্থাদি ও কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এবং মৌর্য যুগে বিবাহের ধরণ ও প্রথা সম্বন্ধে জানা যায় । শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ এবং মেগাস্থিনিসের ভাষ্য সত্ত্বেও অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল । বিবাহ এক জাতির মধ্যে বৈধ হলেও গোত্র ভিন্ন হত । কুল, বংশ বা রক্তের সম্পর্ক থাকলে সেই বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল । তবে একই গোত্রে বিবাহ পুরোপুরি অপ্রচলিত ছিল না । শাক্যদের মধ্যে ভাই-বোন বিবাহও সিদ্ধ ছিল । ‘বৌধায়ন’ ধর্মসূত্রে পিসতুতো-মামাতো ভাই-বোনের বিবাহের কথা জানা যায় । অর্থশাস্ত্রে আট ধরনের বিবাহের কথা বলা হয়েছে । এর মধ্যে আর্য,  ব্রহ্ম, দৈব ও প্রাজাপত্য আগে থেকেই প্রচলিত ছিল ।

ব্রাহ্ম বিবাহ : বর্তমান কালে যেমন পাত্রীকে নতুন কাপড় ও গহনায় সাজিয়ে চরিত্রবান এবং শিক্ষিত পাত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়, তখনকার দিনেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল । এই ধরণের বিবাহ প্রথাকে ব্রাহ্ম বিবাহ বলা হয় ।

দৈববিবাহ : সালংকারা কন্যাকে যজ্ঞের অনুষ্ঠানের সময় পুরোহিতকে সমর্পণ করা হত ।

আর্য বিবাহ : তখনকার দিনে পাত্রপক্ষের কাছ থেকে পণ নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল । যখন পাত্রের কাছ থেকে একটি গরু ও একটি বলদ অথবা দু-জোড়া বলদ গ্রহণ করে কন্যাদান করা হত, তখন সেই বিবাহকে বলা হত আর্য বিবাহ

প্রাজাপত্য বিবাহ : “তোমরা দুজনে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করো” - পাত্রপাত্রীকে শুভ কামনা জানিয়ে এই বিবাহ ।

অন্যান্য বিবাহ : এই চারটি প্রচলিত বিবাহ ছাড়া আরও চারটি বিবাহ পরে স্বীকৃতি পেয়েছিল । সেগুলি হল— আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ ।  

আসুর — পণপ্রথার মাধ্যমে বিবাহ,

গান্ধর্ব — পাত্রপাত্রীর পারস্পারিক ভালোবাসার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন,

রাক্ষস — বলপূর্বক বিবাহ,

পৈশাচ — নিদ্রিতা, পানাসক্তা বা বিকৃতমস্তিষ্কা নারীকে নিয়ে নির্জনে গমন ।

এই সব বিবাহ অবশ্যই সুনজরে দেখা হত না । নিয়ারকাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই সময় স্বয়ম্বর প্রথা প্রচলিত ছিল । দৌড়, কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় যিনি বিজয়ী হতেন, তাঁর সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া হত ।

অসবর্ণ বিবাহ : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অসবর্ণ বিবাহের কথা আছে এবং এর ফলে যে সব সংকর বা মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়েছিল, তা উল্লিখিত হয়েছে, যেমন— অন্বষ্ঠ (পিতা ব্রাহ্মণ, মাতা বৈশ্য), নিষাদ বা পরশর (পিতা ব্রাহ্মণ, মাতা শূদ্র), উগ্র (পিতা ক্ষত্রিয়, মাতা শূদ্র), চন্ডাল (পিতা শূদ্র, মাতা ব্রাহ্মণ), সূত (পিতা ক্ষত্রিয়, মাতা ব্রাহ্মণ) ইত্যাদি । চন্ডালসহ সমস্ত মিশ্র জাতিকে শূদ্রের পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করা হত ।

বিবাহ বিচ্ছেদ : অর্থশাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা উল্লিখিত হয়েছে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের অমিল হলে এবং উভয় পক্ষ রাজি হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যেত । স্বামী দুশ্চরিত্র, চিরপ্রবাসী, রাজদ্রোহী বা ক্লীব হলে স্ত্রী তাকে পরিত্যাগ করতে পারত । স্ত্রী যদি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম হত, তাহলে আট বছর অপেক্ষা করবার পর স্বামী তাকে ত্যাগ করতে পারত । এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী ভরণপোষণ দাবি করতে পারত ।

বিধবা বিবাহ : সাধারণ ভাবে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না । স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার শ্বশুরের অনুমতিতে বা বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারত । সতীদাহের ঘটনা কম হলেও ঘটত ।

বহু বিবাহ : মৌর্য যুগে পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল । অর্থশাস্ত্রে বহু বিবাহের উসাহ দেওয়া হয়নি এবং সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের কথাও বলা হয়েছে । মহিলাদের মধ্যেও বহুবিবাহ একেবারে অজ্ঞাত ছিল না, যদিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদের পক্ষে তা এক প্রকার অসাধ্য ছিল ।

*****

Related Items

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (The Reign of Aurangzeb)

এক নাটকীয় ভ্রাতৃবিরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ঔরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন । ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের চরম বিস্তৃতি ঘটে । আবার তাঁর সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন প্রক্রিয়াও সূচিত হয় । তাঁর সময়ে রাজ্য জয়ের সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল । ...

শাহজাহানের রাজত্বকাল (The Reign of Shahjahan)

পরবর্তী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পুত্র শাহজাহানের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যবাদী নীতি অব্যাহত ছিল। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল দাক্ষিণাত্য বিজয় । পিতা ও পিতামহের অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পূর্ণ করেন । সুন্নি মতাবলম্বী ও শাহজাহানের কাছে শিয়া মতাবলম্বী দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির ...

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল (The Reign of Jahangir)

আকবর তাঁর বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, উদারতা ও দূরদর্শিতায় মুঘল সাম্রাজ্যকে যে গৌরব শীর্ষে উন্নীত করে যান, পরবর্তী কালে তার উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গিরের আমলে তা মোটের উপর অক্ষুণ্ণ ছিল । অবশ্য পরবর্তী যুগের কিছু দুর্বলতা ও সমস্যার বীজ এই সময়েই অনুসন্ধান করা সম্ভব । ...

আকবরের রাজত্ব কাল (The Age of AKbar)

এক চরম সংকটজনক মুহূর্তে আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তখন তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হিমুকে দমন করা । হিমু ছিলেন চুনার থেকে বাংলা সীমান্ত পর্যন্ত তামাম এলাকার শাসক আদিল শাহের উজির । হিমু আগ্রা অধিকার করে দিল্লির অভিমুখে রওনা হন । ...

শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)

শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ । তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গিরদার । ফরিদের বাল্যজীবন সুখের ছিল না । বিমাতার কোপে পড়ে তিনি সাসারাম ছাড়তে বাধ্য হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ ...