প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 09:09

প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন :

অর্থনৈতিক জীবন : কৃষির প্রাধান্য —

(১) বৈদিক যুগ : প্রাচীন ভারতে কৃষিই ভারতের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা ছিল । আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এবং আর্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি । ঋকবৈদিক যুগে পশুচারণই ছিল আর্যদের প্রধান উপজীবিকা এবং গো-সম্পদ ছিল ধনসম্পত্তির মাপকাঠি । ধনী ব্যাক্তিকে বলা হত গোমৎ। গো-ধন অপহরণ নিয়ে আর্য ও উপজাতিদের মধ্যে বিরোধ এবং বিবাদ লেগেই থাকত । তবে ঋক্‌বৈদিক যুগেই চাষবাস শুরু হয় । আবাদি জমিকে ঋক্‌বেদে বলা হত ‘ক্ষেত্র’ ওউর্বরা’ । লাঙলকে বলা হত ‘সির’ । লাঙলের ফলা লোহা দিয়ে তৈরি হত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে । জলসেচের জল নদী থেকে আসত । কূপের জল ব্যাবহৃত হত । সারের ব্যাবহারও জানা ছিল । পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল । ভৌগলিক অবস্থান ও অনুকূল জলবায়ুর জন্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল । উর্বর জমি ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত কৃষির প্রসারে সহায়ক হয়েছিল; আর একটি কারণ ছিল লোহার ব্যাপক ব্যবহার । লাঙলের ফলা ও অন্যান্য কৃষির যন্ত্রপাতি তৈরি হত লোহা দিয়ে । অথর্ব বেদ ও অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, কোনো কোনো লাঙল টানতে ২৪টি পর্যন্ত বলদ লাগত । কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজাত পণ্যে বৈচিত্রও দেখা যায় । ঋক্‌বৈদিক যুগে প্রধান ফসল ছিল যব । ঋক্‌বৈদিক যুগে ধান উৎপন্ন হলেও ধান অর্থে ‘ব্রীহি’ শব্দটি এই প্রথম শুরু হয় । এই সময় আর একটি প্রধান ফসল হলগোধূমবা গম । গম ও যব থেকে তৈরি হয় ‘সক্তব’ বা ছাতু । এই যুগে তিল চাষের শুরু হয় । তা ছাড়া তুলোও  উৎপন্ন হত । বৌদ্ধসাহিত্য থেকে তুলো ও আখ চাষের কথাও জানা যায় । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বাজরা, ভুট্টা, মুগ, সরষে, পান, বেগুন, মুলো, পেঁয়াজ, রসুন, লবঙ্গ, হলুদ, লঙ্কা, গোলমরিচ প্রভৃতির নাম পাওয়া যায় ।

(২) মৌর্য যুগ :  কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ থেকে জানা যায়, মৌর্য যুগে কৃষির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল । কৌটিল্য এই বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব ও উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন । কৌটিল্য মৌর্য যুগে অনাবাদি জমিতে কৃষির বিস্তার, কৃষি ঋণ প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও উদ্যোগের কথা লিখেছেন । এই সময়ে সরকারি উদ্যোগে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয় । সরকারি উদ্যোগে জলসেচের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল সুদর্শন হ্রদ (কাথিয়াবাড়) । রাজকীয় জমিতে কৃষির বিস্তার ও উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর রাখতেন সীতাধ্যক্ষ নামে এক কর্মচারী । সরকারি নিয়ন্ত্রণ সত্বেও মৌর্য যুগে দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয় নি । দুর্ভিক্ষের সময় সরকারি ঋণ ও খয়রাতি সাহায্যের ব্যবস্থা ছিল । মৌর্য সাম্রাজ্যের অবসানের পর কৃষি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমশ কমে এসেছে ।

(৩) গুপ্ত তৎপরবর্তী যুগে কৃষির অবস্থা : গুপ্ত ও তার পরবর্তী যুগেও কৃষির গুরুত্ব অব্যাহত ছিল । সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ ভারতের কৃষি অর্থনীতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন । হিউয়েন সাঙের বিবরণ, কালিদাসের নাটক ও বাণভট্টের হর্ষচরিতথেকে কৃষি সংক্রান্ত বহু তথ্য পাওয়া যায় । কালিদাস বাংলার ধানের প্রসিদ্ধির কথা বলেছেন । বাংলার শালি ধান ছিল বিখ্যাত । হিউয়েন সাঙের বিবরণে মগধে এক ধরনের সুপ্রসিদ্ধ ধানের কথা বলা হয়েছে । এই ধান সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা খুব পছন্দ করতেন । তিনি রাজস্থানে এক ধরনের ধানের কথা বলেছেন, যা ৬০ দিনে পাকত । এই সময় এক-একটি ফসল এক-এক ধরনের জমিতে উৎপন্ন হত । অমরকোষে এই ধরনের ১২টি জমির কথা বলা হয়েছে । এই যুগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ঠ হল তাম্র পট্ট দ্বারা অগ্রহার জমিদান । পুরহিত সম্প্রদায়, অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে এইভাবে করমুক্ত জমি প্রদান করা হত । দান গ্রহীতারা অবশ্যই নিজেরা এইসব জমি চাষ করতেন না । জমি চাষ করার জন্য তারা কৃষক নিযুক্ত করতেন । এই ব্যবস্থায় দান গ্রহীতারা ভূমধ্যধিকারীতে পরিণত হন । ফলে তাঁদের ক্ষমতা ও প্রভাব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল । স্মৃতিকারগণ জমির মালিক অর্থে স্বামীকৃষকঅর্থে চাষিকে বুঝিয়েছেন । এই ব্যবস্থায় বহু অনুর্বর ও অনাবাদি জমি চাষবাসের উপযুক্ত হয় । ফলে কৃষিতে উৎপাদনও বেড়েছিল ।

জমির মালিকানা : ড. ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, রাজাই ছিলেন সমস্ত জমির মালিক । তাঁর এই ধারণা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছিলেন কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল । তাঁর মতে, জমির মালিকানা ছিল ব্যক্তিগত, রাজার নয় । বৈদিক যুগে চাষের জমি ও বাস্তুজমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হলেও গো-চারণ জমি ছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি । বৌধায়ন ধর্মসূত্র থেকে জানা যায় জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল । তবে জমি কেনাবেচার প্রচলন খুব একটা ছিল না । রাজতন্ত্র শাসনাধীন মহাজনপদগুলিতে মনে হয় জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল । কিন্তু লিচ্ছবি, বৃজি, মল্ল প্রভৃতি প্রজাতান্ত্রিক গণরাজ্যগুলিতে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল । পালি সাহিত্যেও এর সমর্থন মেলে । মেগাস্থিনিস ও ডয়োডোরাস মৌর্যযুগে রাজা সমস্ত জমির মালিক ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন । রাজার নিজস্ব জমি অবশ্যই কিছু ছিল । অর্থশাস্ত্রে ওই জমিকেসীতাবলা হয়েছে । কিন্তু জমিতে যে ব্যাক্তিগত মালিকানা ছিল, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে তা জানা যায় । তবে রাজা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে সমস্ত জমির ওপর তাঁর একটা কর্তৃত্ব অবশ্যই ছিল । অধিকাংশ জমির আয়তন হত ছোটো এবং চাষি ও তার পরিবারের লোকজন তা চাষ করত । তাদের জীবনযাত্রা ছিল কঠোর, যদিও পরবর্তীকালে দারিদ্র্য তাদের স্পর্শ করেনি । তারা ঋণভারে জর্জরিত ছিল না । যাই হোক, জমি বড়ো হলে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করা হত বলে জানা যায় । জৈন সূত্রে কৃষি শ্রমিকের কথা জানা যায় । এসব ক্ষেত্রে ভাগচাষির প্রাপ্য ছিল উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ । মৌর্য যুগ, এমনকি তার আগেও, ভূমিহীন কৃষকের অস্তিত্ব ছিল । শারীরিক অসুস্থতা, দুর্ভিক্ষ বা কর প্রদানে অক্ষম হলে, হয় কৃষক জমি বিক্রি করত, না হয় তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হত এবং সে ভাগ চাষিতে পরিণত হত ।

*****

Related Items

মিরজাফর (Mir Jafar)

চক্রান্ত, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ ধরে বাংলার মসনদ দখল করলেও মিরজাফর গোড়া থেকেই তাঁর অসহায় এবং অক্ষম অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিলেন । আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যার চাপে তিনি ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন । তাঁর বিরুদ্ধে যে সব বিদ্রোহ হয়েছিল ...

নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

প্রথমদিকে সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ছিল আশাতিত । তিনি বিনা রক্তপাতে মাসি ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে নজরবন্দি করেন । অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলিবর্দি খানের দ্বিতীয় কন্যার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব সৌকত জঙ্গকে মনিহারির যুদ্ধে পরাজিত করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন । তার আগেই তিনি ...

সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশির যুদ্ধ

পলাশির যুদ্ধের দুটি দিক ছিল । (১) ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধ ও (২) বাংলার মসনদ দখলে মিরজাফরের উচ্চাকাঙ্খা । সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিরাজকেই দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে, সিরাজের অহমিকা ও দম্ভ, অপরিমিত ...

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন :- কর্ণাটকে যখন ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব চলছিল, মোটামুটি প্রায় সেই সময় বাংলায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছিল । ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টব্দের মধ্যে বাংলার কর্তৃত্ব স্বাধীন নবাবদের হাত থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় ...

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । কিন্তু ডুপ্লের মতো কোন যোগ্য নেতার অনুপস্থিতিতে ফরাসিরা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এই সময়ে কর্ণাটকে যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন লালি । কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ভালো ছিল না । ফলে ফরাসিদের মধ্যে ...