প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের স্থান

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 09:04

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের স্থান :

(১) বৈদিক যুগে নারীর স্থান : প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান নিয়ে বিতর্ক আছে । সাধারণভাবে বলা হয় বৈদিক যুগে নারীর স্থান ছিল খুব উপরে । পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত হলেও তার যত্ন ও লালনপালনে কোনো ত্রুটি থাকত না । তার শিক্ষার দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হত । ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারা -র মতো নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন । উপনিষদের যুগে গার্গী -র মতো দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল । তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের মতো পণ্ডিতের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন । উচ্চবর্ণের মহিলারা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যাগযজ্ঞে অংশ নিতেন । তাঁরা সম্পত্তির অধিকারিণীও ছিলেন এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ইচ্ছা করলে পুনর্বিবাহ করতে পারতেন । কিন্তু বৈদিকযুগে, বিশেষত পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অবস্থা যে সবটাই ভাল ছিল তা নয় । ক্রমে সমাজে শূদ্র ও নারীদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল । নারীকে বলা হত ‘ভার্ষা’; অর্থা, ভরণীয়া বা যাকে ভরণ করতে হয় । তার স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না । শিশুকালে সে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বয়সকালে বা বৈধব্য জীবনে পুত্রের অধীন । পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও নারীদের মধ্যে তা ছিল না । স্ত্রীকে তার স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে হত । অথর্ব বেদে অবশ্য নারীদের বহুবিবাহের কথা উল্লেখ আছে । ঋকবৈদিক যুগে বিবাহ নারীর পক্ষে বাধ্যতা মূলক না হলেও পরে তা হয়েছিল । এই সময়ে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল না । বিধবা বিবাহ প্রচলন ছিল তা সে দেওরের সঙ্গেই হোক, বা অন্য কারও সঙ্গে । অথর্ব বেদের যুগে সহমরণ বা সতীদাহের কথা জানা যায় । বিবাহে কন্যাপণের কথাও জানা যায় । ঋক্‌বৈদিক যুগের গোড়ায় নারী গৃহে আবদ্ধ থাকত না; এমনকি মুদগলিনী, বিশপলা, শশিয়সী প্রভৃতি নারীর নাম পাই, তাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু পরে ক্রমশ নারীর স্থান হয়েছিল অন্তঃপুরে । পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়াই ছিল তার প্রধান কাজ । নিঃসন্তান বা শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়া নারীকে পরিত্যাগ করার অধিকার তার স্বামীর ছিল । সেক্ষেত্রে স্বামী আবার বিবাহ করতে পারত । নারীর যৌন অপরাধের কোনো ক্ষমা ছিল না । কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা প্রশ্রয় পেত । নারীর মন বলে কিছু আছে, তা মনে করা হত না, এমনকি তাকে মারধোর করবার অধিকার তার স্বামীর ছিল । এক কথায় বলা যায়, প্রাচীন যুগে ‘নারীস্বাধীনতা’ ছিল বলে অনেকের যে ধারণা আছে, তা অনেকাংশে ভ্রান্ত বলে মনে করা হয় নারী ছিল পুরোপুরি পুরুষের অধীন এবং তারই “সম্পত্তি” ।

(২) বেদ পরবর্তীযুগে নারীর স্থান : বেদ পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটেছে । বৌধায়নের ‘ধর্মশাস্ত্রে’, মনু প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রকারদের রচনা, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, বাৎসায়নের‘ কামসূত্র’, কালিদাসের বিভিন্ন নাটক, বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ ও ‘হর্ষচরিত’, হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’, মাঘের ‘শিশুপালবধ’, দন্ডির ‘দশকুমারচরিত’, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে নারীর দুরাবস্থার কথা জানতে পারা যায় । পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমিকা ছিল শুধুমাত্র পুত্রের মাতা । তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না । স্বয়ংবর গান্ধর্ব বিবাহ পদ্ধতি ক্রমশ অপ্রচলিত হয়ে পড়ে এবং আর্য ও আসুর বিবাহ প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । বিধবা বিবাহ ক্রমশ উঠে যেতে থাকে এবং জীবনের বাকি অংশ তারা শোক এবং কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে থাকে । তবে পর্দাপ্রথা ছিল না । নারীরা উৎসব এবং খেলাধূলায় অংশ গ্রহণ করতে পারত । হর্ষবর্ধনের সময় অর্থাৎ সপ্তম শতকে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল । শিক্ষাদীক্ষা উচ্চবর্ণের নারীদের মধ্যে সীমিত হয়ে যায় । তাদের বেদপাঠ নিষিদ্ধ হয় । সমাজে একমাত্র পতিতারাই শিক্ষিতা এবং স্বাধীন ছিল । তবে বৌদ্ধ ও জৈন পরিবারের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল । সাহিত্যে অবশ্য নারীকে প্রেমিকা রূপে দেখানো হয়েছিল । কলহন রক্ষণশীল ও নারী স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন । আবার এইযুগে লীলাবতী খনা -র মতো বিদূষী মহিলারও সাক্ষাৎ মেলে । নারী স্বাধীনতা না থাকলেও তাদের যথেষ্ঠ সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হত । স্বামীকে তার সাধ্যমতো স্ত্রীর ভরণপোষণ, বিলাসসামগ্রী, এবং অলংকারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হত । নারীদের তিরস্কার এবং মারধোর করা নিন্দনীয় ছিল । যে সব পুরুষ তাদের স্ত্রীদের মারধোর করে, ঈশ্বর তাদের পূজা গ্রহণ করেন না বলে শাস্ত্রের বিধান ছিল ।

*****

Related Items

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (The Reign of Aurangzeb)

এক নাটকীয় ভ্রাতৃবিরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ঔরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন । ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের চরম বিস্তৃতি ঘটে । আবার তাঁর সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন প্রক্রিয়াও সূচিত হয় । তাঁর সময়ে রাজ্য জয়ের সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল । ...

শাহজাহানের রাজত্বকাল (The Reign of Shahjahan)

পরবর্তী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পুত্র শাহজাহানের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যবাদী নীতি অব্যাহত ছিল। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল দাক্ষিণাত্য বিজয় । পিতা ও পিতামহের অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পূর্ণ করেন । সুন্নি মতাবলম্বী ও শাহজাহানের কাছে শিয়া মতাবলম্বী দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির ...

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল (The Reign of Jahangir)

আকবর তাঁর বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, উদারতা ও দূরদর্শিতায় মুঘল সাম্রাজ্যকে যে গৌরব শীর্ষে উন্নীত করে যান, পরবর্তী কালে তার উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গিরের আমলে তা মোটের উপর অক্ষুণ্ণ ছিল । অবশ্য পরবর্তী যুগের কিছু দুর্বলতা ও সমস্যার বীজ এই সময়েই অনুসন্ধান করা সম্ভব । ...

আকবরের রাজত্ব কাল (The Age of AKbar)

এক চরম সংকটজনক মুহূর্তে আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তখন তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হিমুকে দমন করা । হিমু ছিলেন চুনার থেকে বাংলা সীমান্ত পর্যন্ত তামাম এলাকার শাসক আদিল শাহের উজির । হিমু আগ্রা অধিকার করে দিল্লির অভিমুখে রওনা হন । ...

শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)

শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ । তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গিরদার । ফরিদের বাল্যজীবন সুখের ছিল না । বিমাতার কোপে পড়ে তিনি সাসারাম ছাড়তে বাধ্য হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ ...