প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 14:51

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান (Sources of Ancient Indian History) :

(১) সাহিত্যিক উপাদান (The Literary Elements) : সমকালীন ঐতিহাসিকদের রচনা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক সাহিত্য কীর্তি হল মূলত ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদান । সাহিত্যিক উপাদানের নির্ভরযোগ্যতা সম্মন্ধে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়, কারণ এখানে ভূল তথ্য বা অনিচ্ছাকৃত তথ্য পরিবেশনের সুযোগ থাকে । 

(২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপদান (Archaeological Evidence) : প্রাচীন লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের নিদর্শন ও ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতি হল ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান । প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের নির্ভরযোগ্যতা অনেক বেশি, কারণ এখানে ভূল তথ্য পরিবেশনের সুযোগ প্রায় নেই ।

(১) সাহিত্যিক উপাদান মূলত দুই ভাগে বিভক্ত : (i) দেশীয় সাহিত্য (Indigenous Literature of ancient times) ও (ii) বৈদেশিক বিবরণ (Accounts of  foreign Travelers)

(i) দেশীয় সাহিত্য (Indigenous Literature of ancient times) : দেশীয় সাহিত্যকেও প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়—

(ক) ধর্মীয় গ্রন্থ (Sacred literature) : প্রাচীন ভারতের অধিকাংশ গ্রন্থ ধর্মকে ভিত্তি করে লেখা । হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক ও জাতক এবং জৈন ধর্মগ্রন্থ কল্পসুত্র পরিশিষ্ট পর্বন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রগুলি যেমন 'নারদ স্মৃতি',  'বৃহস্পতি স্মৃতি',  'মনুস্মৃতি' থেকে প্রাচীন ভারতের আর্থসামাজিক তথ্য সম্পর্কে একটা ধারনা উপলব্ধি করা যায় ।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ (Secular Literature) : আইন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়ের উপর যে সমস্ত বই লেখা হয়েছিল সে গুলিকে প্রাচীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ বলা হয় । এইগুলির মধ্যে কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', পাণিনির 'অষ্টাধ্যায়ী', পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য', ভাসের 'স্বপ্নবাসবদত্তা', শূদ্রকের 'মৃচ্ছকটিকম' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস' কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম''মালবিকাগ্নিমিত্রম' প্রভৃতি নাটক থেকে ইতিহাসের বহু তথ্য সংগৃহিত হয় । 

(গ) জীবন চরিত (Biography) : প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজাদের জীবনচরিতগুলির মধ্যে বাণভট্ট রচিত 'হর্ষচরিত', সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত 'রামচরিত' বিলহন রচিত 'বিক্রমাঙ্কদেবচরিত' বাকপতি রচিত 'গৌড়বহ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এই জীবনচরিতগুলি মূলত রাজাদের সভাকবিদের লেখা বলে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ।

(ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস : স্থানীয় বা আঞ্চলিকভাবে রচিত গ্রন্থের মধ্যে কাশ্মীরের উপর লিখিত কলহন বিরচিত 'রাজতরঙ্গিনী' সোমেশ্বর রচিত 'রাসমালা' ও 'কীর্তি কৌমুদী' সিংহলী উপাখ্যান 'দ্বীপবংশ' ও ' মহাবংশ' এবং রাজশেখর রচিত 'প্রবন্ধকোষ' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

(ii) বৈদেশিক বিবরণ (Accounts of  foreign Travelers) : বিদেশি পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের বিবরণ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বহু মূল্য উপাদান সংগৃহিত হয় । বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ তিন শ্রেণির ।  

(ক) গ্রিক বিবরণ : মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' অজ্ঞাত পরিচয় গ্রিক নাবিকের লেখা 'পেরিপ্লাস অফ দ্য ইরিথ্রিয়ান সি' টলেমির ভূগোল, প্লিনি, কুইন্টাস, কার্টিয়াস, এ্যারিব্যান, প্লুটার্ক, ডায়োডোরাস প্রমুখ গ্রিক ও রোমান লেখকদের রচনা ও বিবরণ বিশেষভাবে স্মরনীয় ।  

(খ) চৈনিক ভ্রমণবৃত্তান্ত : গুপ্তযুগে ফা-হি-য়েন, হর্ষবর্ধনের আমলে হিউয়েন সাঙ ও ইৎ-সিং এর বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

(গ) আরব পর্যটকদের বিবরণ : মুসলিম পর্যটকদের মধ্যে আলবেরুনী রচিত 'তহকক-ই-হিন্দ' এবং আল মাসুদী, আল বিলাদুরি , সুলেমান, হাসান নিজামি প্রমুখদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

(২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপদান (Archaeological Evidence) : প্রত্নতাত্ত্বিক উপদানগুলিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (i) লিপি  (ii) মুদ্রা ও (iii) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ।

(i) লিপি (Inscriptions) : পাথর, তামা, লোহা, ব্রোঞ্জ ও পোড়ামাটির উপর খোদাই করা লিপি থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় । সে জন্য লিপিকে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল বলে অভিহিত করা হয় । সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের ভাষা ও বক্তব্যের পরিবর্তন ঘটলেও লিপি সবসময় অপরিবর্তিত থাকে বা তথ্য বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।

লিপিকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়— (ক) দেশীয় লিপি ও (খ) বিদেশি লিপি ।

(ক) দেশীয় লিপি (Indigenous Inscriptions) : ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, তামিল, পালি, সংস্কৃত, প্রাকৃত প্রভৃতি বহু ভাষায় লেখা প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় রাজাদের রাজ্যজয়, রাজপ্রশস্তি, ভূমিদান, শাসন, ধর্ম, রাজনৈতিক ঘটনা, ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতি । প্রাচীন ভারতের লিপিগুলির মধ্যে 'অশোকের শিলালিপি' সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া হরিসেন বিরচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে সমুদ্রগুপ্তের বিজয় কাহিনী জানা যায় । কলিঙ্গরাজ খারবেলের 'হস্তিগুম্ফা লিপি', প্রতিহাররাজ ভোজের 'গোয়ালিয়র প্রশস্তি', বিজয় সেনের 'দেওপাড়া লিপি', চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর 'আইহোল লিপি', শকক্ষত্রপ রুদ্রদমনের 'জুনাগড় লিপি' বিশেষ উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত লিপির পাঠোদ্ধার আজও হয়নি । দাক্ষিণাত্যের পল্লব, চোল, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, বাকাটক প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাসের জন্য লিপির উপর নির্ভরশীল হতে হয় । ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ, ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার, প্রমুখ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে লিপিকে প্রথম স্থানে রেখেছেন ।

(খ) বিদেশি লিপি (Foreign Inscriptions) : এশিয়া মাইনর, কম্বোডিয়া, চম্পা, যবদ্বীপ, গ্রিস ও পারস্য প্রভৃতি বৈদেশিক অঞ্চলগুলি থেকে পাওয়া লিপিগুলি থেকে এইসব অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইতিহাস পাওয়া যায় ।    

(ii) মুদ্রা (Coins) : রাজার নাম ও সাল-তারিখ মুদ্রা থেকে জানা যায় । ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও ধাতুবিদ্যার উৎকর্ষতা মুদ্রা মারফত জানতে পারা যায় । মুদ্রায় অঙ্কিত চিত্রের মাধ্যমে সেই রাজার গুণাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা করা যায় । যেমন সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে তাঁর সঙ্গীতানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায় । ব্যাকট্রীয়, গ্রিক, শক, কুষান রাজাদের কাহিনী মুদ্রা থেকেই জানতে পারা যায় । সাতবাহন সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উপাদান হল মুদ্রা । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে ।     

(iii) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ (Monumental Evidence) : প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ, স্মৃতিসৌধ, মন্দির, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী । হরপ্পা, মহেন-জো-দরোর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত না হলে ভারত ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় আমাদের কাছে অজ্ঞাত থেকে যেত । সাঁচি, নালন্দা, অজন্তা, ইলোরা, তক্ষশীলা ইত্যাদি অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান দেয় । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে ভারতবর্ষের বাইরে উপনিবেশ ও সংস্কৃতি বিস্তারের কথা জানতে পারা যায় ।

*****

Related Items

মুসলিমদের আগমনে সংঘাত ও সমন্বয়ী প্রক্রিয়া

মুসলমানরা ভারতে একটি সম্পূর্ণ নতুন ও উন্নত ধর্ম চেতনা ও জীবনাদর্শ নিয়ে এসেছিল । দুটি সম উন্নত মানের ধর্ম ও সংস্কৃতি যখন মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তখন কাউই কাউকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারে না । প্রাথমিক সংঘাত অনিবার্য । এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । হিন্দু-মুসলমান পরস্পর ...

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঔরঙ্গজেবের আমল থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল । ঔরঙ্গজেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যের বিশালায়তন অব্যাহত ছিল । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিভূত হয় । মুঘল সাম্রাজ্যের ...

জায়গিরদারি সংকট ও আঞ্চলিক বিদ্রোহ

ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটলেও তাঁর সময় থেকেই পতনের প্রক্রিয়া সূচিত হয় । জায়গিরদারি সংকট ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই সংকট তীব্রতর হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের আমলে একটানা যুদ্ধ ও বিশেষত তাঁর ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি ...

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System)

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System) :

মনসবদারি প্রথা (Mansabdari System) : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল সামরিক শাসন । জনগণের সেখানে কোন ভূমিকা ছিল না । জনসমর্থন নয়, ভীতিই ছিল এই শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যদিও আগেই বলা হয়

মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ও সংহতি

আকবরই মুঘল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । রাষ্ট্রশাসনে আকবর সরকারের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের মঙ্গলের কথাও চিন্তা করতেন । তাঁর প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতীয় ও সুলতানি শাসনের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল । বিশেষত শের শাহ প্রবর্তিত শাসন ...