গিয়াসউদ্দিন বলবন (Ghias-ud-din Balban)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 05/07/2012 - 15:14

গিয়াসউদ্দিন বলবন (Ghias-ud-din Balban) :

ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর ইলবেরি তুর্কিজাত সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালোভী । 'চল্লিশ চক্রে'র প্রভাবশালী সদস্য হিসাবে তাঁর ষড়যন্ত্রে ইলতুৎমিসের কন্যা রাজিয়া এবং দুই পুত্র রুকন উদ্দিন ফিরোজবাহরাম শাহের পতন ঘটে । পরবর্তী সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দিয়ে ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন 'নায়েব-ই-মামলিকাৎ' পদে নিযুক্ত হন । তিনি ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জামাতা নাসিরুদিন মামুদকে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন । গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । সিংহাসনে আরোহণ করার পরে গিয়াসউদ্দিন বলবন এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন । ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের অপদার্থতার ফলে সুলতানি শাসনের ভিত যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল । দিল্লির কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে যায় এবং মান-মর্যাদা হ্রাস পায় । অন্যদিকে আমির-ওমরাহদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে দিল্লী সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয় । এই পরিস্থিতিতে গিয়াসউদ্দিন বলবন শক্ত হাতে হাল ধরেন ও একজন দক্ষ শাসকের পরিচয় দেন । এই পরিস্থিতিকে সামাল দেবার মতো যোগ্যতা গিয়াসউদ্দিন বলবনের ছিল ।

(ক) সমস্যা সমাধানের প্রস্তুতি : গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজ ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজ্যে আইন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন । রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্য সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন । তিনি অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব যোগ্য হস্তে অর্পণ করে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন । তারপর তিনি দিল্লী ও দোয়াব অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য মেওয়াটি দস্যুদের দমন করেন । ভবিষ্যতে যাতে তারা পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে না পারে, তার জন্য তিনি গোয়ালিয়রে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন । দোয়াব অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য তিনি কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন ও জালালির দুর্গটি মেরামত করেন ।

(খ) স্বৈরতন্ত্রের আদর্শ ক্ষমতার প্রকৃতি : গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁর স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থাকে কায়েম করতে একটি শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক আদর্শ ও তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন । দিল্লি সুলতানির মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । পারসিক শাসকদের অনুকরণে তিনি তাঁর রাজসভা গড়ে তোলেন । পারসিক আদব-কায়দা ও প্রথা চালু করে তিনি জনগণের সম্ভ্রম আদায় করেন । তিনি রাজসভায় সব সময় সুসজ্জিত হয়ে ও অনুচরবর্গ দ্বারা বেষ্ঠিত হয়ে প্রবেশ করতেন । রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদের দরজা সাধারণ লোকের কাছে বন্ধ করে দিয়েছিলেন । বাইরের চাকচিক্য দিয়ে লোকের মন ভুলিয়ে এইভাবে তিনি তাদের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব জাগিয়ে তোলেন । সুলতানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন সুলতানের প্রধান কর্তব্য হল চারটি, যথা— (১) ধর্ম ও শরিয়তের অনুশাসন মেনে চলা, (২) অন্যায় কাজ কর্ম বন্ধ করা, (৩) ধার্মিক ব্যক্তিকে সরকারি কর্মে নিয়োগ করা এবং (৪) ন্যায় বিচার করা । তিনি বলতেন "রাষ্ট্রের গৌরব নির্ভর করে এমন এক শাসন ব্যবস্থার ওপরে, যা জনগণকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলে" ।

(গ) মোঙ্গল আক্রমণ : আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গল আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, গিয়াসউদ্দিন বলবন দৃষ্টি দেন । তিনি লাহোরের দুর্গটি পুনরায় নির্মাণ করার আদেশ দেন । দীর্ঘদিন ধরে সুলতানের আত্মীয় শের খান যোগ্যতার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন । গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁকে সন্দেহবশত হত্যা করেন বলে ঐতিহাসিক বরনি অভিযোগ করেন । এই হত্যাকান্ড গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজনৈতিক অদুরদর্শিতার পরিচায়ক । শের খানের হত্যার ফলে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ হয় । তখন সুলতান জ্যৈষ্ঠ পুত্র মহম্মদকে সুলতানের শাসক নিযুক্ত করেন ও দ্বিতীয় পুত্র বুগরা খানকে সামান ও সুনামের দায়িত্ব দেন । এঁদের যৌথ প্রচেষ্ঠায় সাময়িকভাবে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত হয় । কিন্তু মোঙ্গলরা আবার আক্রমণ করলে মহম্মদ প্রাণ হারান । সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন এই শোকে শেষ পর্যন্ত ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান ।

(ঘ) কৃতিত্ব :

(১) যে অবস্থার মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন, তাতে সুলতানকে বাধ্য হয়েই অনেক সময় কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হয় । সিংহাসনে আরোহণের পর অসীম সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন চরম প্রতিক্রিয়াশীল 'চল্লিশ চক্রে'র উচ্ছেদ করেন ।

(২) সুলতান হয়ে তিনি একদিকে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যদিকে সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিজের দুই পুত্রকে মোতায়েন করেন ।

(৩) দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলে তিনি মেওয়াটি দস্যুদের কঠোর ভাবে দমন করে রাজধানীর নিরাপত্তা বজায় রাখেন ।

(৪) বাদাউনের নিকটবর্তী অঞ্চলের রাজপুত দুর্গগুলি ধ্বংস করেন এবং রাজপুত জমিদারদের সম্ভাব্য বিদ্রোহ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সেখানে আফগান সৈন্য মোতায়েন করেন ।

(৫) পরবর্তীকালে বাংলার শাসনকর্তা তুঘরিল খাঁর বিদ্রোহ দমন করে গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হন ।

(৬) অভিজাতদের গতিবিধির উপর লক্ষ রাখার জন্য তাঁর আমলে অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয় ।

যাই হোক, যে দৃঢ়তার সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সুলতানিকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে । তিনি সারা জীবনই অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পান নি । স্বৈরতন্ত্রী শাসনকে তিনি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করতে পারেন নি । সন্দেহ ও অবিশ্বাস তাঁর বিচারবুদ্ধিকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল । সামরিক দক্ষতার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন তিনি রাখতে পারেন নি । কিন্তু এই সমস্ত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না । তিনি দিল্লি সুলতানির স্থায়িত্ব প্রদান করেন ।

১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর দাস বংশের (Slave dynasty) পতন শুরু হয় ।

*****

Related Items

প্রাচীন ভারতের বিবাহ প্রথা

ধর্মসূত্র গ্রন্থাদি ও কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এবং মৌর্য যুগে বিবাহের ধরণ ও প্রথা সম্মন্ধে জানা যায় । শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ এবং মেগাস্থিনিসের ভাষ্য সত্ত্বেও অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল । বিবাহ এক জাতির মধ্যে বৈধ হলেও গোত্র ভিন্ন হত । ...

প্রাচীন ভারতের দাসপ্রথা

গৌতম বুদ্ধের সময় সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল । রাজপরিবার, ধনী পরিবার ও সাধারণ মানুষও ঘরের কাজের জন্য দাস-দাসী নিযুক্ত করত । ঘরদোর পরিষ্কার করা, রান্নাবান্না করা, মাঠের কাজ করা ছিল দাস-দাসীদের প্রধান কাজ । তবে কোনো বিশেষ বর্ণের মানুষ দাস-দাসীর কাজ করত না । ...

প্রাচীন ভারতের পারিবারিক জীবন

প্রাচীন ভারতে সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার । আর সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক । অর্থাৎ পুরুষরা বা পিতা ছিলেন পরিবারের প্রধান । অবশ্য মাতাও সন্মান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন । প্রাচীন ভারতে পরিবার ছিল যৌথ । মাতা, পিতা, পুত্র, পুত্রবধূ ও অন্যান্য সবাই একত্রে বসবাস করত । ...

প্রাচীন ভারতের সামাজিক রূপান্তর

আর্যরা প্রথমে যাযাবর জীবনযাপন করত । তাদের প্রধান উপজীবিকা ছিল পশু পালন ও খাদ্য সংগ্রহ । যেহেতু তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াত তাই তারা কৃষিকাজ বা চাষবাস করত না । তারা খাদ্য-উৎপাদকের ভুমিকা পালন করত না, বরং খাদ্য-সংগ্রাহকের ভুমিকা পালন করত । ...

রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়েছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল । রাজনৈতিক প্রাধান্যের জন্য এদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই ছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো শক্তিই সার্বভৌম ...