ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (The Reign of Aurangzeb)

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 09/10/2014 - 20:46

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (১৬৫৮ - ১৭০৭)

The Reign of Aurangzeb

এক নাটকীয় ভ্রাতৃবিরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ঔরঙ্গজেব ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । ঔরঙ্গজেব ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের চরম বিস্তৃতি ঘটে । আবার তাঁর সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন প্রক্রিয়াও সূচিত হয় । তাঁর সময়ে রাজ্য জয়ের সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল । আসলে রাজ্যজয় অপেক্ষা হৃত রাজ্য ও গৌরব পুনরুদ্ধার করাই ছিল অনেক বেশি জরুরি । শাহজাহানের রাজত্বের শেষ দিকে উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল । যাই হোক, যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গেই ঔরঙ্গজেব এই কাজ করতে সক্ষম হন । বিকানির ও বুন্দেলখন্ডে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় । এই সঙ্গে অবশ্য রাজ্যজয়ের কাজও অব্যাহত ছিল । এভাবে পালামৌ, কোচবিহার, চট্টগ্রাম, আসাম ও ওড়িশা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় । দক্ষিণ ভারতে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডাও মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুকালে মুঘল সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে জিঞ্জি ও পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত থেকে পূর্বে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।

মুঘল সাম্রাজের পতনে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকা :

প্রথমত, সর্বাধিক বিস্তৃতি মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করবার পরিবর্তে দুর্বল করেছিল । উত্তর-পূর্ব ভারতে সুদূর বাংলা ও আসামে, দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে ঔরঙ্গজেব সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করেন । উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বিভিন্ন আফগান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে একই ভাবে সাফল্য অর্জন করেন । তবে তিনি দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারেন নি । অতীতে সমুদ্রগুপ্ত বা আলাউদ্দিন খলজি— দুজনের কেউই দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রাখবার চেষ্টা করেন নি ।

দ্বিতীয়ত, ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতির ফলেও মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায় । তিনি আকবর প্রবর্তিত রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার নীতি পরিত্যাগ করে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তোলেন । মারওয়ার ও মেবারের সঙ্গে তাঁর যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তাতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ।

তৃতীয়ত, দাক্ষিণাত্যে মারাঠা বীর শিবাজীর অভ্যুথানের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তা মোকাবিলা করতে ঔরঙ্গজেব ব্যর্থ হন । দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক অরাজকতা ও সুলতানি রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শিবাজি মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সচেষ্ঠ হন । ঔরঙ্গজেব বিজাপুরের সুলতানের সহযোগিতায় শিবাজির রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হলেও, তা তাঁর নিজের দোষে নষ্ট হয়ে যায় । শিবাজির অগ্রগমন তিনি রুখতে পানেন নি । বরং মারাঠা শক্তি, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা— এই তিন শক্তি মিলিত ভাবে মুঘলদের বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল । ঔরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল করতে সক্ষম হলেও মারাঠাদের রুখতে পারেন নি । ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে শিবাজির মৃত্যুর পর মারাঠারা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়লেও ব্যাপক লুঠতরাজ করে মুঘলদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল । ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ আরও প্রশস্ত করেছিল ।

চতুর্থত, ঔরঙজেবের ভ্রান্ত নীতির ফলে শিখ, জাঠ ও সৎনাম বিদ্রোহ মুঘল সাম্রাজ্যের শান্তি ও স্থায়িত্ব বিঘ্নিত করেছিল । এই বিদ্রোহগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফল মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে সুখকর হয়নি । ঔরঙ্গজেব যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন অবশ্য মুঘল সাম্রাজ্য অটুট ছিল । কিন্তু তাঁর রাজত্বকালেই এই প্রশস্ত সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রস্তুত হয় ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...