অভিব্যক্তির স্বপক্ষে অঙ্গসংস্থান অঙ্গসংস্থানগত ও জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ

Submitted by arpita pramanik on Thu, 12/20/2012 - 23:44

অভিব্যক্তির স্বপক্ষে অঙ্গসংস্থানগত ও জীবাশ্মঘটিত বা প্রত্নজীববিদ্যা সংক্রান্ত প্রমাণ (Morphological and Palaentological Evidence in favour of Evolution)

'জীব জগতে অভিব্যক্তি ঘটছে' —এই তথ্যের স্বপক্ষে নানা প্রমাণ পাওয়া যায় । এইসব প্রমাণগুলি হল :

[ক] অঙ্গসংস্থান সংক্রান্ত প্রমাণ [Morphological Evidence]:-

জীবদেহের যে সমস্ত অঙ্গের বাহ্যিক গঠন ও কাজ আলাদা হলেও উত্পত্তি এবং অভ্যন্তরীণ গাঠনিক কাঠামো মূলগতভাবে [basically] এক, তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে ।

বিভিন্ন প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গের প্রাথমিক গঠনগত মিল দেখে জৈব-বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় । এগুলির মধ্যে মেরুদন্ডী প্রাণীদের অগ্রপদ, হৃতপিন্ড ও লুপ্তপ্রায় অঙ্গ ঘটিত সাদৃশ্য জৈব বিবর্তনের স্ব-পক্ষে উত্কৃষ্ট প্রমাণ, যেমন; 

[1] অগ্রপদের সাদৃশ্য [Similarity in limbs]:- তিমি, ঘোড়া, পাখি, মানুষ ইত্যাদির অগ্রপদের অস্থির গঠনের তুলনা করলে তাদের  মধ্যে একটি সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, যেমন এদের প্রত্যেকের অগ্র বাহুই প্রায় একইরকম অস্থি দিয়ে গঠিত

যেমন : তিমির প্যাডেল, মানুষের হাত, বাদুড় ও পাখির ডানা, ঘোড়ার সামনের পা প্রভৃতি অঙ্গগুলি একই ভাবে উত্পত্তি লাভ করেছে । প্রত্যেকক্ষেত্রেই এইসব অঙ্গগুলি হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা, কারপ্যালস, মেটাকারপ্যালস ফ্যালানেজস ইত্যাদি হাড় নিয়ে গড়ে উঠেছে ।

এইসব অঙ্গের মধ্যে যেসব আপাত পার্থক্য দেখা যায় সেগুলি বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য ঘটেছে, যেমন : পাখির ও বাদুড়ের অগ্রপদ (ডানা) আকাশে উড়বার অঙ্গ; ঘোড়ার অগ্রপদ দৌড়বার উপযুক্ত, তিমির অগ্রপদ (প্যাডেল) সাঁতার কাটবার অঙ্গ এবং মানুষের অগ্রপদ (হাত) কোনও বস্তুকে ধরা অথবা সুক্ষ্ম কোনও কাজ করার উপযুক্ত অঙ্গ ।

এই সব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন রকম মেরুদন্ডী প্রাণী একই রকম পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে । সমসংস্থ অঙ্গগুলো অভিসারী বিবর্তনকেও নির্দেশ করে । 

[2]  হৃৎপিন্ড ঘটিত সাদৃশ্য [Similarity in hearts]:- নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিভিন্ন জীবের কোনও অঙ্গের গঠন পর্যালোচনা করলে তাদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, একে তুলনামূলক শারীরস্থানীয় প্রমাণ বলা হয় । যেমন : মাছ, ব্যাঙ সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী —ইত্যাদি মেরুদন্ডী প্রাণীগোষ্ঠীর হৃৎপিন্ডের গঠনের তুলনা করলে দেখা যাবে যে, এরা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত । হৃৎপিন্ডের গঠন ও কার্যকারিতা মাছ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদেহে ক্রমশ সরল থেকে জটিল হয়েছে । মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ডের গঠন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে মাছের হৃৎপিন্ড দুই প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, উভচরদের হৃৎপিন্ড তিন প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, সরীসৃপদের নিলয়টি অর্ধবিভক্ত হয়েছে, যা পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত হয়ে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত হৃৎপিন্ডের উদ্ভব হয়েছে ।  হৃৎপিন্ডের এই রকম ধারাবাহিকতা থেকে অনুমান করা যায় যে মাছ থেকে উভচর, উভচর থেকে সরীসৃপ এবং সরীসৃপ থেকে দুই ধারায় পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্ভব হয়েছে ।

[i]  মাছের হৃৎপিন্ড:- মাছের হৃৎপিন্ড দু'প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : একটি অলিন্দ ও একটি নিলয়, যা গঠনগত ভাবে খুবই সরল এবং জলে বাস করার উপযুক্ত ।

[ii]  ব্যাঙের হৃৎপিন্ড:- ব্যাঙ উভচর প্রাণী ; এদের হৃৎপিন্ড তিন প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : দুটো অলিন্দ ও একটি নিলয় । তবুও মাছের মতো ব্যাঙের হৃৎপিন্ডে দূষিত এবং বিশুদ্ধ রক্তের মিশ্রণ ঘটে ।

[iii]  সরীসৃপ প্রাণীর হৃৎপিন্ড:- সরীসৃপ শ্রেণিভুক্ত প্রাণীর হৃৎপিন্ড বেশি উন্নত ধরনের । এটি অসম্পূর্ণভাবে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : দুটো  অলিন্দ এবং অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত দুটো নিলয় নিয়ে গঠিত । এখানে দূষিত এবং বিশুদ্ধ রক্তের মিশ্রণ রোধ করার চেষ্টা দেখা যায় ।

[iv]  পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড:- পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড সম্পূর্ণভাবে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত যা দুটো অলিন্দ এবং দুটো নিলয় নিয়ে গড়ে উঠেছে, এর ফলে দূষিত রক্ত এবং বিশুদ্ধ রক্ত কখনই মিশতে পারে না ।

সুতরাং, মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, এরা সকলেই একই পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং এদের অঙ্গগুলিও সরল থেকে ক্রমশ জটিল ও উন্নতমানের হয়েছে । হৃৎপিন্ডের তুলনামূলক শারীরস্থান থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে :

[i]  সমস্ত জীব একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং

[ii] সরল জীব থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে জটিল জীবের উদ্ভব বা অভিব্যক্তি ঘটেছে ।

[3] নিষ্ক্রিয়, ক্ষয়িষ্ণু বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গঘটিত সাদৃশ্য [Similarity in Vestigial Organs]:- জীবদেহের যে সব অঙ্গ এককালে পূর্বপুরুষের দেহে সক্রিয় ছিল, কিন্তু ক্রমবিবর্তনের ফলে বর্তমান প্রজন্মে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের এবং কাজহীন অঙ্গে পরিণত হয়েছে, তাদের লুপ্তপ্রায় বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে ।

প্রাণীদের বিভিন্ন ক্ষয়িষ্ণু অঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলেও জৈববিবর্তন সম্পর্কে ধারণা জন্মায় । যেমন : গিনিপিগের সক্রিয়া অঙ্গ 'সিকাম' মানুষের ক্ষেত্রে 'অ্যাপেন্ডিক্স' নামে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে । বানরের সক্রিয় অঙ্গ লেজ মানুষের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কক্সিস -এ রুপান্তরিত । এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, সক্রিয় অঙ্গ বিশিষ্ট প্রাণী থেকে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বিশিষ্ট প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে

প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও লুপ্তপ্রায় অঙ্গের সন্ধান মেলে । ভূনিম্নস্থ কান্ডের শল্কপত্র, আম, কাজুবাদাম, কালকাসুন্দির বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড, শতমূলী উদ্ভিদের বন্ধ্যা গর্ভকেশর বা পিস্টিলোড লুপ্তপ্রায় অঙ্গ ।

এই সব ঘটনা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, নিষ্ক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীব, ওই একই প্রকৃতির সক্রিয় অঙ্গযুক্ত পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে ।                       

কয়েকটি নিষ্ক্রিয় অঙ্গের তালিকা

নিষ্ক্রিয় অঙ্গের নাম  যে অঙ্গের নিষ্ক্রিয় রূপ  যে জীবদেহে অবস্থিত
1.ভার্মি ফর্ম অ্যাপেন্ডিক্স সিকাম মানুষ
2. উপপল্লব নিকটিটেটিং পর্দা    মানুষ
3. কক্সিস লেজ মানুষ
4. নিষ্ক্রিয় পশ্চাদপদ  সক্রিয় পশ্চাদ পদ পাইথন
5. নিষ্ক্রিয় ডানা সক্রিয় ডানা উটপাখি
6. স্ট্যামিনোড   পুংকেশর  কালকা সুন্দি
7. পিস্টিলোড গর্ভকেশর  শতমুলি 
8. শল্ক পত্র  পাতা ভূনিম্নস্থ কান্ড 

*****

Related Items

টীকাকরণ এবং অনাক্রম্যতাকরণ

দেহে জীবাণু বা জীবাণুসৃষ্ট পদার্থ কৃত্রিমভাবে প্রবেশ করিয়ে ওই রোগের সাপেক্ষে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়াকে টীকাকরণ বলে, এবং যে পদার্থকে দেহে প্রবেশ করানো হয়, তাকে টীকা বলে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অথবা খাওয়ানোর দ্বারা প্রতিষেধক টীকা দেহে প্রবেশ ...

সাধারণ জীবাণু নাশকের ব্যবহার

বিভিন্ন রোগ-জীবাণু প্রতিরোধের জন্য নানা ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয় । সাধারণত জীবাণুনাশকগুলি প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে, যেমন : প্রাকৃতিক, ভৌত এবং রাসায়নিক। সূর্যালোক এবং বাতাস স্বাভাবিক জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে । সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির ...

রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগ সমূহ

কোনো রোগের কারণে অথবা ক্ষতের মাধ্যমে দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত নির্গত হয়ে গেলে, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে । বর্তমানে বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক, নার্সিং হোম অথবা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনের জন্য রক্ত পাওয়া যায় ...

পতঙ্গ বাহকের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগসমূহ

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের সংক্রমণের ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে । মানবদেহে খাদ্যের সাথে, জলের সাথে, বাতাসের মাধ্যমে, বিভিন্ন পতঙ্গ অথবা অপর জীবের দেহের সাথে সংলগ্ন হয়ে অথবা তাদের দংশনের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ হয় । এছাড়াও রোগাক্রান্ত অথবা প্রাণীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ...

প্রোটোজোয়া (Protozoa)

এককোশী আণুবীক্ষণিক প্রাণীদের প্রোটোজোয়া বা আদ্যপ্রাণী বলা হয় । আদ্যপ্রাণীদের মধ্যে কিছু প্রাণী মানবদেহে পরজীবীরূপে বসবাস করে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি করে । এখানে পাঠক্রমভুক্ত কয়েকটি আদ্যপ্রাণীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হল - প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স