ভারতীয় সামন্ততন্ত্র (Indian Feudalism)

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 09:49

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র (Indian Feudalism) :

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র একটি অত্যন্ত ব্যাপক, জটিল ও বিতর্কিত বিষয় । সাধারণত ‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি মধ্যযুগে ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়ে থাকে । বর্বর আক্রমণের এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে নবম শতকে মূলত পশ্চিম ইউরোপে এই প্রতিষ্ঠানটি বিকশিত হয়েছিল । ভূমি কেন্দ্রিক ও ভূমি নির্ভর এই প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বর্বর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা । অর্থাৎ, সামন্ততন্ত্র একটি ভূমি নির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা । মধ্যযুগে ইউরোপীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের প্রভাব ছিল ব্যাপক । তাই মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজকে ঐতিহাসিকগণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বলে চিহ্নিত করে থাকেন । মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা অবশ্য সামন্ততন্ত্রকে একটি উৎপাদন ব্যবস্থা বলে মনে করেন ।

সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ঠ্য : সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ঠ্যগুলি হল—

(ক) রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ । ইউরোপে যখন একের পর এক বর্বর আক্রমণ হচ্ছিল, তখন এই আক্রমণকে প্রতিহত করবার ক্ষমতা ইউরোপীয় রাজাদের ছিল না । ফলে বাধ্য হয়ে রাজারা সামরিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব স্থানীয় লর্ড বা ভূস্বামীদের হাতে ছেড়ে দেন । এভাবে রাজারা তাঁদের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা লর্ডের সঙ্গে ভাগ করে নিলে এক বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে ।

(খ) পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা এই ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ঠ্য । এক্ষেত্রে রাজা ও লর্ড ছিল একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল । বস্তুত রাজা ছিলেন ওভার লর্ড বা বড়ো লর্ড । এই নির্ভরশীলতা অবশ্যই সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্র । লর্ড আবার নির্ভরশীল তাঁর অধঃস্তন ভ্যাসালদের উপর । ভ্যাসাল আবার লর্ডের উপর নির্ভরশীল । এভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা তৈরি হয় চুক্তির মাধ্যমে । স্তরে স্তরে বিভক্ত এই সমাজে একেবারে উপরে থাকতেন রাজা, আর একেবারে নীচে থাকতেন ভূমিদাস বা জমিতে আবদ্ধ পরাধীন কৃষকেরা । এই ভূমিদাসদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ ছিল ভূস্বামী বা লর্ডদের । এদের সম্পর্ক ঠিক সহযোগিতার ছিল না, চুক্তির মাধ্যমে এই সম্পর্ক তৈরি হত না । এই সম্পর্ক ছিল শোষণ বা অত্যাচারের । ভূমিদাসেরাই ছিল অত্যাচারিত ও শোষিত ।

(গ) জমির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বা কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতি ছিল এই সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বাণিজ্য বিশেষত বহির্বাণিজ্যের স্থান ছিল একেবারে নীচের দিকে । কৃষিনির্ভর হলেও উৎপাদন বাড়াবার সুযোগ এই ব্যবস্থায় ছিল না । এক গ্রামকেন্দ্রিক (বা ম্যানরকেন্দ্রিক; ম্যানর বলতে বোঝায় এক বড় ভূমিখন্ড) আবদ্ধ অর্থনীতি এই সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ।

ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব রামশরণ শর্মার অভিমত : সামন্ততন্ত্রের এই সমস্ত বৈশিষ্ঠ্য মাথায় রেখে কোনো কোনো ভারতীয় ঐতিহাসিক খ্রিস্টীয় ৬০০ থেকে ১২০০ এই সময়কালকে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন । এই সময়কালে ভারতীয় আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে এঁরা দাবি করেন । ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের কথা প্রথমে বলেন ডি. ডি. কোশাম্বি পরে রামশরণ শর্মা বিস্তৃত ভাবে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের ব্যাখ্যা দেন । তাঁর মতে, ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উন্মেষ ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ।  তারপর ৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ— এই সময়কালে এই ব্যবস্থার ব্যাপক বিকাশ ঘটে । ৯০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই ব্যবস্থার চুড়ান্ত পরিণতি ও ভাঙন ধরেছিল । ইউরোপের অনুকরণে ড. শর্মা ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের কতগুলি বৈশিষ্ট্য খুঁজবার চেষ্টা করেছেন । সেগুলি হল—

(i) ইউরোপের মতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর এই বিশেষ অবস্থা তৈরি হয় । রাজারা প্রায়শই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অগ্রহার (বা নিষ্কর জমি, যে জমির খাজনা ভোগ করবে ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তি) দান করতেন । পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাক্তিকেও অগ্রহার দান করা হত । এর ফলে আঞ্চলিক প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ও এক বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে ।

(ii) অগ্রহার দানের ফলে কেবল রাজনীতি বা প্রশাসনে নয়, অর্থনীতি বা সমাজ জীবনেও এক নতুন প্রবণতার জন্ম হয় । ড. শর্মা মনে করেন খ্রিস্টীয় ৬০০ থেকে ১২০০ শতকের সময়কালে অর্থনীতি মূলত কৃষিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে । বহির্বাণিজ্যের উপস্থিতি এই সময়কালে চোখে পড়ে না । মুদ্রার অনুপস্থিতি ও নগরের পতন বাণিজ্যের অবক্ষয়ের চিত্র বহন করে । শিল্পের বিকাশ ও বাণিজ্যের সঙ্গে নগরের বা শহরের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে । ড. শর্মা হিউয়েন সাঙের বিবরণের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, গাঙ্গেও উপত্যকায় নগরের পতন ঘটেছিল । এই নগরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— কৌশাম্বী, কপিলাবস্তু, শ্রাবস্তী, বৈশালী, প্রভৃতি । এইভাবে ইউরোপের মতো ভারতবর্ষেও এক কৃষিনির্ভর আবদ্ধ অর্থনীতি গড়ে ওঠে, যেখানে ভূস্বামীরা প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠেন । কৃষকদের অবস্থা হয়ে ওঠে শোচনীয় এবং এরা ক্রমশ জমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছিল । পুরাণে কৃষকদের বলা হত ‘আশ্রিতহালিক’, ‘বদ্ধহল’, ইত্যাদি । এর থেকে প্রমাণিত হয় কৃষকরা জমিতে আবদ্ধ ছিল এবং তাদের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না । এই অবস্থা ইউরোপের ভূমিদাস ব্যবস্থার অনুরূপ । ড. শর্মা একথা স্বীকার করেন যে, এই সময়কালে কৃষির প্রসার ঘটেছিল এবং উৎপাদনও বেড়েছিল ।

সমালোচনা — বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি : ড. শর্মার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক সহমত পোষণ করেন না । হরবন্স মুখিয়া, দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রজদুলাল চট্টপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, চম্পক লক্ষ্মী প্রমুখেরা মনে করেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্র শব্দটি প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত নয় । ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ৬০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ এই সময়কালের ভারতীয় ইতিহাসের অদ্ভুত মিল থাকলেও অমিলও ছিল অনেক বেশি । শর্মার অনেক বক্তব্য এঁরা তথ্য নিষ্ঠ ভাবে অনেকাংশে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছেন ।

প্রথমত, বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা মানেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন ভাবার কোনো কারণ নেই ।

দ্বিতীয়ত, এখানে ভূস্বামীদের সামরিক সাহায্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না, যা ইউরোপে ছিল । কারণ, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই সময়কালে বর্বর আক্রমণের ভয়াবহতা দেখা যায়নি ।

তৃতীয়ত, মুদ্রার অনুপস্থিতি, নগরের অবক্ষয়, বাণিজ্যের পতন বা বাণিজ্য শূন্যতা— এগুলির কোনোটিই সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয় । এই সময়কালে বেশ কিছু নগরের পতন ঘটলেও নতুন কিছু শহরও গড়ে উঠেছিল । তা ছাড়া কাশী, বারাণসী বা পাটলিপুত্রের মতো প্রাচীন শহরের অস্তিত্ব এই সময়তেও ছিল । ব্যবসাবাণিজ্যও এই সময় চলেছিল । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিন এবং আরবের সঙ্গে এ সময় বহির্বাণিজ্য চলত । তাছাড়া শর্মা কথিত কৃষির প্রসার তো বাণিজ্যের প্রসারেও সাহায্য করবে । অর্থনীতি পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে পড়েছিল— এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই ।

চতুর্থত, কৃষিতে স্বাধীন শ্রমের ব্যবহারও অব্যহত ছিল । তা-ছাড়া আশ্রিতহালিক বা বদ্ধহল শব্দগুলির ব্যাখ্যা পুরাণে নেই । কাজেই এই শব্দগুলি ভূমিদাসের সমার্থক কিনা, নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন । ভারতীয় কৃষকেরা ইউরোপীয় ভূমিদাসের পর্যায়ে পৌঁছেছিল কিনা, এ বিষয়ে ড. শর্মা নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ।

উপসংহার : বস্তুত, ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্তে আসা খুবই কঠিন । ড. শর্মার অনেক ব্যাখ্যাই ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে । ইউরোপীয় আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ভারতবর্ষকে ফেললে জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় । তবে শর্মার ব্যাখ্যার মধ্যে যে অভিনবত্ব ছিল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।

*****

Related Items

মিরজাফর (Mir Jafar)

চক্রান্ত, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ ধরে বাংলার মসনদ দখল করলেও মিরজাফর গোড়া থেকেই তাঁর অসহায় এবং অক্ষম অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিলেন । আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যার চাপে তিনি ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন । তাঁর বিরুদ্ধে যে সব বিদ্রোহ হয়েছিল ...

নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

প্রথমদিকে সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ছিল আশাতিত । তিনি বিনা রক্তপাতে মাসি ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে নজরবন্দি করেন । অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলিবর্দি খানের দ্বিতীয় কন্যার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব সৌকত জঙ্গকে মনিহারির যুদ্ধে পরাজিত করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন । তার আগেই তিনি ...

সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশির যুদ্ধ

পলাশির যুদ্ধের দুটি দিক ছিল । (১) ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধ ও (২) বাংলার মসনদ দখলে মিরজাফরের উচ্চাকাঙ্খা । সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিরাজকেই দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে, সিরাজের অহমিকা ও দম্ভ, অপরিমিত ...

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন :- কর্ণাটকে যখন ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব চলছিল, মোটামুটি প্রায় সেই সময় বাংলায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছিল । ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টব্দের মধ্যে বাংলার কর্তৃত্ব স্বাধীন নবাবদের হাত থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় ...

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । কিন্তু ডুপ্লের মতো কোন যোগ্য নেতার অনুপস্থিতিতে ফরাসিরা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এই সময়ে কর্ণাটকে যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন লালি । কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ভালো ছিল না । ফলে ফরাসিদের মধ্যে ...