প্রশ্ন : বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।
উঃ- রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি সহ ২৪ জন প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে রাশিয়ার তাসখন্দে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর 'ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি' গড়ে তোলেন, সম্পাদক হন মহম্মদ সিদ্দিকি । তবে ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের কানপুরে, সম্পাদক হন সচিদানন্দ বিষ্ণু ঘটে । দুবার জন্মের জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে 'দ্বিজ' বলা হয় ।
কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার সাথে সাথে ভারতের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন অন্য মাত্রা লাভ করে । তবে মানবেন্দ্রনাথ রায় কৃষক অপেক্ষা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন, কারণ জমির প্রতি কৃষকদের লোভকে তিনি পুঁজিবাদী মনোভাব বলে মনে করতেন । ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিক শোষণ বন্ধ করা, জমিদারি প্রথার বিলোপ, সাম্যবাদের প্রসার ঘটানো, কৃষক শ্রমিক সাধারণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল করা এবং ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা । বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা— সোসালিস্ট, ইনকিলাব, গণবাণী, লাঙ্গল, লেবার কিষান গেজেট, কীর্তি প্রভৃত প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নও তৈরি হয় যেমন— 'গিরনি কামগড় ইউনিয়ন' ।
শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে মাদ্রাজের সমুদ্র তটে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সিঙ্গায়াভেল্লু চেট্টিয়ারের নেতৃত্বে প্রথম মে দিবস পালিত হয় । কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য ঘটাতে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত সরকার, মুজাফফর আহমেদ, নলিনী গুপ্ত, ধরণী গোস্বামী প্রমুখরা 'ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি' গড়ে তোলেন । এই দলই প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করে— সম্পূর্ণ স্বাধীনতা কংগ্রেসের লক্ষ্য হওয়া উচিত ।
বামপন্থীদের প্রভাবে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রায় ২০৩টি শ্রমিক ধর্মঘট হয় যাতে প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিক যোগ দেয় । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার চটকলগুলিতে শ্রমিকরা সর্বাত্মক ধর্মঘটে নামে এবং দেড় লক্ষ শ্রমিক এতে যোগ দেয় । বামপন্থীদের ব্যাপক প্রসার, শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে তাদের প্রভাব এবং কলকারখানায় ক্রমাগত ধর্মঘট ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে । শ্রমিকদের থেকে কমিউনিস্টদের আলাদা করা এবং তাদের দমন করার জন্য সরকার 'জননিরাপত্তা বিল' পাস করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে 'মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা' শুরু করে ।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুলাই ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘোষণা করলে বামপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত গণ আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা গ্রহণ করে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে অভিহিত করে বামপন্থীরা এই যুদ্ধে ব্রিটেনের বিরোধিতা করে । কিন্তু জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে তারা ব্রিটেনের বিরোধিতা থেকে সরে আসে । তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বামপন্থীরা নতুন উদ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে । আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপতি রশিদ আলির বিচার ও কারাদন্ডকে কেন্দ্র করে তারা আন্দোলনে নামে এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি 'রশিদ আলি দিবস' পালন করে । স্বাধীনতার প্রাককালে কৃষক আন্দোলন তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ । তবে দেশভাগের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, যে কারণে তারা বিভিন্নভাবে সমালোচিত হন ।
*****