তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঊর্মিমালা
পৃষ্ঠা - ১১
ঊর্মি ভাবে, লোকটা সর্বজ্ঞনাকি। ভগ্নীপতিকে ওর খুব ভালো লাগে সন্দেহ নেই। তার প্রধান কারণ, শশাঙ্ক হো হো করে হাসতে পারে, উৎপাত করতে জানে, ঠাট্টা করে। আর ঠিকটি জানে ঊর্মি কোন্ ফুল ভালোবাসে আর কোন্ রঙের শাড়ি।
ঊর্মি বললে, “হাঁ, আমার ভালো লাগে সে কথা সত্যি।”
নীরদ বললে, “শর্মিলাদিদির ভালোবাসা স্নিগ্ধগম্ভীর, তাঁর সেবা যেন একটা পুণ্যকর্ম, কখনো কর্তব্য থেকে ছুটি নেন না। তারই প্রভাবে শশাঙ্কবাবু একমনে কাজ করতে শিখেছেন। কিন্তু যেদিন তুমি ভবানীপুরে যাও সেই দিনই ওঁর যেন মুখোশ খসে পড়ে, তোমার সঙ্গে ঝুটোপুটি বেঁধে যায়, চুলের কাঁটা তুলে নিয়ে খোঁপা এলিয়ে দেন, হাতে তোমার পড়বার বই দেখলে আলমারির মাথার উপর রাখেন তুলে। টেনিস খেলবার শখ হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে, হাতে কাজ থাকলেও।”
ঊর্মিকে মনে মনে মানতেই হল যে, শশাঙ্কদা এইরকম দৌরাত্ম করেন বলেই তাঁকে ওর এত ভালো লাগে।ওর নিজের ছেলেমানুষি তাঁর কাছে এলে ঢেউ খেলিয়ে ওঠে। সেও তাঁর ‘পরে কম অত্যাচার করে না। দিদি ওদের দুজনের এই দুরন্তপনা দেখে তাঁর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি হাসেন। কখনো বা মৃদু তিরস্কারও করেন, কিন্তু সেটা তিরস্কারের ভান।
নীরদ উপসংহারে বললে, “যেখানে তোমার নিজের স্বভাব প্রশ্রয় না পায় সেইখানেই তোমার থাকা চাই। আমি কাছে থাকলে ভাবনা থাকত না, কেননা আমার স্বভাব একেবারে তোমার বিপরীত। তোমার মন রক্ষে করতে গিয়ে তোমার মনকে মাটি করা, এ আমার দ্বারা কখনোই হতে পারত না।”
ঊর্মি মাথা নিচু করে বললে, “আপনার কথা আমি সর্বদাই স্মরণ রাখব।”
নীরদ বললে, “আমি কতকগুলো বই তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি। তার যে-সব চ্যাপ্টারে দাগ দিয়েছি
সেইগুলো বিশেষ করে পোড়ো, এর পরে কাজে লাগবে।”
ঊর্মির পক্ষে এই সাহায্যের দরকার ছিল। কেননা ইদানীং মাঝে মাঝে তার মনে কেবলই সন্দেহ আসছিল, ভাবছিল, ‘হয়তো প্রথম উৎসাহের মুখে ভুল করেছি। হয়তো ডাক্তারি আমার ধাতের সঙ্গে মিলবে না।’
নীরদের দাগ-দেওয়া বইগুলো ওর পক্ষে শক্ত বাঁধনের কাজ করবে, ওকে টেনে নিয়ে চলতে পারবে উজান-পথে।
নীরদ চলে গেলে ঊর্মি নিজের প্রতি আরো কঠিন অত্যাচার করলে শুরু। কলেজে যায়, আর বাকি সময় নিজেকে যেন একেবারে জেনেনার মধ্যে বদ্ধ করে রাখে। সারা দিন পরে বাড়ি ফিরে এসে যতই তার শ্রান্ত মন ছুটি পেতে চায় ততই সে নিষ্ঠুরভাবে তাকে অধ্যয়নের শিকল জড়িয়ে আটকে রাখে। পড়া এগোয় না, একই পাতার উপর বার বার করে মন বৃথা ঘুরে বেড়ায়, তবু হার মানতে চায় না। নীরদ উপস্থিত নেই বলেই তার দূরবর্তী ইচ্ছাশক্তি ওর প্রতি অধিক করে কাজ করতে লাগল।
নিজের উপর সব চেয়ে ধিক্কার হয় যখন কাজ করতে করতে আগেকার দিনের কথা কেবলই ফিরে ফিরে মনে আসে। যুবকদলের মধ্যে ওর ভক্ত ছিল অনেক। সেদিন তাদের কাউকে বা উপেক্ষা করেছে, কারো প্রতি ওর মনের টানও হয়েছিল। ভালোবাসা পরিণত হয় নি, কিন্তু ভালোবাসার ইচ্ছেটাই তখন মৃদুমন্দ বসন্তের হাওয়ার মতো মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াত। তাই আপন-মনে গান গাইত গুন গুন করে, পছন্দসই কবিতা কপি করে রাখত খাতায়। মন অত্যন্ত উতলা হলে বাজাত সেতার। আজকাল এক-এক দিন সন্ধেবেলায় বইয়ের পাতায় যখন চোখ আছে তখন হঠাৎ চমকে উঠে জানতে পারে যে, তার মনে ঘুরছে এমন কোনো দিনের এমন কোনো মানুষের ছবি যে দিনকে যে মানুষকে পূর্বে সে কখনোই বিশেষভাবে আমল দেয় নি। এমন-কি, সে মানুষের অবিশ্রাম আগ্রহে সেদিন তাকে বিরক্ত করেছিল। আজ বুঝি তার সেই আগ্রহটাই নিজের ভিতরকার অতৃপ্তির বেদনাকে স্পর্শ করে করে যাচ্ছে, প্রজাপতির ক্ষণিক হালকা ডানা ফুলকে যেমন বসন্তের স্পর্শ দিয়ে যায়।
এ-সব চিন্তাকে যত বেগে সে মন থেকে দূর করতে চায় সেই বেগের প্রতিঘাতই চিন্তাগুলিকে ততই ওর মনে ঘুরিয়ে নিয়ে
পৃষ্ঠা - ১১
- 47 views