অসহযোগ আন্দোলন (Non Co-operation Movement) :
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর নাগপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশনে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন প্রথম একটি বৃহত্তম গণআন্দোলন ছিল । সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করে ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে ব্যর্থ করে দেওয়াই ছিল গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য । দীর্ঘ ৩৫ বছর পর কংগ্রেস তার চিরাচরিত আবেদন-নিবেদন নীতি তথা 'রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি' পরিত্যাগ করে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দিকে অবতীর্ণ হয়েছিল । গান্ধিজি কয়েকটি বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব সকলের সামনে ব্যক্ত করেন । এই উদ্দেশ্যগুলি হল—
(১) খিলাফৎ সমস্যার যথাযত সমাধানের দাবি জানানো ।
(২) ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক আইনগুলি, বিশেষভাবে কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরোধিতা করা ।
(৩) জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানানো ও পাঞ্জাবে নিষ্ঠুর পুলিশি তাণ্ডবের জন্য দায়ী জেনারেল ডায়ার সমেত সমস্ত অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা ।
(৪) ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশের সমস্ত অন্যায় অবিচারের চিরস্থায়ী প্রতিকার বিধান করা ।
(৫) এক বছরের মধ্যে স্বরাজ অর্জন করা ।
(৬) অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, মাদক বর্জন এবং সমগ্র জাতিকে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও যাবতীয় ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করে তোলাও অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য রূপে গৃহীত হয়েছিল ।
এই সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গান্ধিজি তাঁর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন । কর্মসূচির নেতিবাচক দিকগুলি হল—
(১) আইনসভা ও সরকারি অফিস আদালত বর্জন করা,
(২) সরকারি উপাধি, পদক, খেতাব, সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠান ইত্যাদি বর্জন করা,
(৩) সরকারি স্কুলকলেজ থেকে ছেলেমেয়েদের নাম প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া,
(৪) সমস্ত বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জন করা,
(৫) সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্যপদ বর্জন করা,
(৬) সকল শ্রেণির সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারীর বিদেশ গমনে অস্বীকৃতি ইত্যাদি ।
আন্দোলনের ইতিবাচক দিকগুলি হল—
(১) চরকায় সুতো কাটা এবং খাদি বস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন করা,
(২) জাতীয় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ,
(৩) নিরক্ষরতা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা,
(৪) দেশীয় শিল্পজাত পণ্য গ্রহণ করা,
(৫) দেশের গণ্যমান্য মানুষদের নিয়ে সালিশি বোর্ড গঠন করা ইত্যাদি ।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস এই কর্মসূচি গ্রহণ করে গান্ধিজিকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব অর্পণ করেন । জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলেন । অসংখ্য ছাত্র স্কুল, কলেজ বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল । দেশবাসীর উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে কাশী বিদ্যাপীঠ, বারাণসী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় । ডক্টর জাকির হোসেন, আচার্য নরেন্দ্র দেব, লালা লাজপত রায় প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ এই সব নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন । মতিলাল নেহরু, ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ আইনজীবীগণ আইন ব্যবসা ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন । সুভাষচন্দ্র বসু সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে এবং জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ হাইকোর্ট ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন । মহাত্মা গান্ধির ডাকে ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ সরকারি উচ্চপদে ইস্তফা দিয়ে, প্রফুল্ল সেন, অজয়্ কুমার মুখার্জি উচ্চশিক্ষার মোহ বর্জন করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন । এভাবে একে একে মেদিনীপুরের যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নদিয়ার হেমন্ত সরকার, বরিশালের যতীন সেন, ময়মনসিং -এর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ আরও অনেকে তাঁদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে এগিয়ে আসেন । অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠে জাতীয় মুক্তিবাহিনী । শুধু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল নয়, দেশের শ্রমিক শ্রেণি কলকারখানা ছেড়ে এবং কৃষক শ্রেণি ও গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও এই অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন । সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, মেদিনীপুরের কৃষক, মহারাষ্ট্রের শ্রমিক, উত্তরপ্রদেশের ক্ষেতমজুর, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলে এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন । ঘরে ঘরে ত্যাগের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল । সমস্ত দেশ জুড়ে গান্ধিজি যে অহিংস বাহিনী গড়ে তুললেন তারা পোশাকে স্বতন্ত্র, আচরণে বিনম্র, প্রতিজ্ঞায় অটল, এবং ব্যক্তিত্বে অনন্য । তাদের পরণে খদ্দরের ধুতি, মাথায় টুপি, প্রত্যেকেই যেন আত্মত্যাগ ও শুভ্রতার প্রতীক । অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, "আমরা দেখলাম যে সমস্ত গ্রামাঞ্চল উদ্দীপনার এক আশ্চর্য উন্মাদনায় ভরপুর ।" আমেদাবাদে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুসারে গান্ধিজি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি সুরাট জেলার বরদৌলিতে গণ আইন অমান্য আন্দোলনের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেন । এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয় । কিন্তু এই আন্দোলন শুরুর আগেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেরুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় একদল হিংসাত্মক জনতা এক পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশ কর্মচারীকে পুড়িয়ে মারে । গান্ধিজির কানে এই সংবাদ পৌঁছুলে তিনি তৎক্ষণাৎ আন্দোলন বন্ধের আদেশ দেন । সারাদেশ তাঁর এই আদেশে স্থম্ভিত হয় । মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হন । কেউ একে 'জাতীয় বিপর্যয়' কেউ 'পর্বত প্রমাণ ভুল' বলে মন্তব্য করেন । তথাপি কংগ্রেস কার্য নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন ।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসহযোগ আন্দোলন গভীর প্রভাব ফেলেছিল ।
(১) এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসীর মধ্যে গান্ধিজির অবিসম্বাদিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ।
(২) কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় দলরূপে প্রতিষ্ঠা পায় ।
(৩) সকল শ্রেণির মানুষের যোগদানে আন্দোলন একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয় ও জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের মানসিকতা জন্ম নেয় ।
(৪) আন্দোলনের ফলে একদিকে যেমন দারিদ্র, অস্পৃশ্যতা, মাদক সেবনের বিরুদ্ধে জনগণ সচেতন হয়, অন্যদিকে খাদি ও কুটির শিল্পের বিকাশের ফলে দেশ ও জাতি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করে ।
(৫) প্রচলিত ব্রিটিশ শাসনের প্রতি গ্রাম, গঞ্জ ও শহরের মানুষের মধ্যে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল ।
(৬) ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করতে অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম ।
সাংবিধানিক ভাষ্যকার কুপল্যান্ড -এর মতে বালগঙ্গাধর তিলক যা করতে পারেনি গান্ধিজি তা করতে পেরেছেন । গান্ধিজি জাতীয় কংগ্রেসকে বিপ্লবমুখী করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন ।
*****
- 25719 views