দ্বৈত শাসনব্যবস্থা (Diarchy in West Bengal)

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 04/21/2012 - 12:20

দ্বৈত শাসন (Implication of Diarchy in Bengal)

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানির পক্ষে লর্ড ক্লাইভ বাংলার নবাব নজম-উদ্-দৌলাকে কাঙ্ক্ষিত ৫৩ লক্ষ টাকা দেবার বিনিময়ে রাজস্ব আদায় এবং দেওয়ানি মামলার ভার গ্রহণ করলেন । দেশ শাসনের দায়িত্ব আগের মতোই নবাবের হাতে রইলো । এই ব্যবস্থা ইতিহাসে দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত । এই ব্যবস্থায় বাংলার নবাব সামান্য বৃত্তিভোগী কর্মচারীতে পরিণত হলেন । আর প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ইংরেজ কোম্পানি এদেশের প্রকৃত প্রভু হয়ে বসলেন । নবাব ও কোম্পানির মধ্যে এই ক্ষমতা ভাগাভাগির ফলে দেশশাসন ও প্রজাসাধারনের মঙ্গল বিধানের দায়িত্ব কেউই পালন করত না । ফলে বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ দেখা দেয় । ক্ষমতাহীন নবাব সেই বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হন । কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব বিভাগের দুই সহকারী রেজা খাঁসিতাব রায়ের শোষণ ও অত্যাচারে প্রজাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না । পরিণতিতে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । এটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ।

যে সমস্ত কারণে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিলেন:-

১) বাংলায় দ্বৈতশাসনের ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ দেখা দিলে, দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসনব্যবস্থা, শোষণ ও অত্যাচার প্রভৃতির কথা ইংল্যান্ডে প্রচারিত হলে ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সমাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজেকর্মে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয় ।

২) বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভীষিকাময় খবরে ইংল্যান্ডের শাসকবর্গ বিচলিত হয়ে পড়েন এবং উপলব্ধি করেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন আর নিছক একটি বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান নয়, তখন তা একটি সাম্রাজ্য পরিচালনা করে, যা আরও সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা দরকার ।

৩) ইংল্যান্ডের শাসকবর্গের কাছে আরও খবর এসে পৌছায় যে, দ্বৈতশাসন বাংলার বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল এবং দূর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছে । কারণ কোম্পানির ‘নায়েব-দেওয়ান’ ও কর্মচারীরা কোম্পানির স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থরক্ষাতেই ব্যস্ত থাকেন ।

৪) পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর থেকেই কোম্পানির কর্মচারীরা দুর্নীতি, ঘুষ, ভেট এবং ব্যক্তিগত বাণিজ্যসহ নানান অবৈধ উপায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে দেশে ফিরে গিয়ে মহা আড়ম্বরের সঙ্গে বাস করতে থাকেন । ভারত থেকে আগত এইসব কর্মচারীদের দেখে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হয়ে পড়েন, এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রনে এনে এই সব অসৎ কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সু্যোগ খুঁজতে থাকেন । ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে বলেন যে, ‘কোম্পানির কার্যকলাপ ব্রিটিশ জাতির নামে কলঙ্ক লেপন করেছে, সুতরাং এখনই কিছু করা প্রয়োজন’ ।

৫) বাংলা তথা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে সম্পদ লুট করেও কোম্পানির আর্থিক অবস্থার বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি, বরং তাদের আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে । এই অবস্থায় কোম্পানিকে ‘ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড’ লোন দিতে অস্বীকার করে । কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ১০ লক্ষ পাউন্ড ঋণের আবেদন জানায় । তাদের ঋণ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে কিনা তা খতিয়ে দেখবার জন্য ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে । তখন বাংলায় কোম্পানির শাসনের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে । এই কমিশনের রিপোর্ট থেকে ইংল্যান্ডের লোক জানতে পারে যে, কোম্পানি তথা বাংলার দুর্দশা বৃদ্ধির জন্য দায়ী ছিল কোম্পানির নায়েব-দেওয়ান ও অন্যান্য কর্মচারীদের সীমাহীন লাভের আকাঙ্খা ।

এই অবস্থায়ঃ-

১) ব্রিটিশরা ভারতের শানব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ।

২) বাংলার দৈত্ব শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ।

ব্রিটিশ জনগণের এই কোম্পানিবিরোধী মনভাবের ফলশ্রুতি হিসাবে:-

১) ১৭৭২ সালে বাংলায় দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটানো হয়,

২) ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং আইন এবং ১৭৮৪ সালের পিট -এর ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি দমনে উদ্যোগ নেয় ।

*****

Related Items

গোরা (Gora)

গোরা (Gora) of Rabindranath Tagore :-

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রচিত গোরা উপন্যাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই  উপন্যাসের কয়েকটি মুখ্য চরিত্র হল— গোরা, আনন্দময়

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat)

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat) :-

'বর্ত্তমান ভারত' স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি প্রবন্ধ । ১৮৯৭ সালে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করেন । তারপর ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মু

আনন্দমঠ (Anandamath)

আনন্দমঠ (Anandamath):-

ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতী

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Expression of Nationalism in Literary Works and Paintings):-

ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা শুরু হয় ও ক্রমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । স

হিন্দু মেলা (Hindu Mela)

হিন্দু মেলা (Hindu Mela) :-

ঊনিশ শতকে বাংলায় যেসমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল 'হিন্দুমেলা' । পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চৈত্রসংক্রান্তির