১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি কী ছিল ? বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হিসেবে বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল ?

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 01/10/2022 - 16:26

প্রশ্ন:  ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি কী ছিল ? বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হিসেবে বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল ?

বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি :

(১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শীঘ্রই প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে পরিনত হয় । এই গণআন্দোলনের প্রথম ও মুখ্য কর্মসূচি ছিল ‘বয়কট’ । ‘বয়কট’ কথার অর্থ হল বর্জন । স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ‘বয়কট’ কথাটির অর্থ ছিল শুধুমাত্র বিলিতি বস্ত্র বা বিলিতি জিনিসপত্রই নয়, বিলিতি চিন্তাধারা, আদব-কায়দা, শিক্ষাব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা, পৌরসভা, আইনসভা প্রভৃতিকে বর্জন করার নীতি বা আদর্শ । কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সামগ্রিক বয়কট আন্দোলনের আহ্বান জানানো হয় ।

(২) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই বাগেরহাটে এক বিশাল জনসভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘বয়কটের’ প্রস্তাব নেওয়া হয় । এই প্রস্তাবে বলা হয় যে, যতদিন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ না করা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রী বর্জন করা হবে এবং আগামী ছয় মাস পর্যন্ত সব রকমের জাতীয় আনন্দ-উৎসবের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে ।

(৩) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জুলাই দিনাজপুরের মহারাজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় যে সব প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জেলাবোর্ড, পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের সব সদস্যরা পদত্যাগ করবেন এবং আগামী এক বছর ধরে জাতীয় শোক পালন করা হবে ।

(৪) ক্রমে ক্রমে বাংলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে জনসভা আয়োজিত হয় এবং বিলাতি পণ্যসম্ভারের বিরুদ্ধে বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হয় ।

(৫) ‘বয়কট’ আন্দোলনে বাংলার ছাত্র সমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ১৯০৫ সালে ১৭ই ও ১৮ই জুলাই রিপন কলেজে বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে এক ছাত্র সমাবেশে ‘বয়কট' কে আদর্শ পবিত্র শপথ হিসাবে গ্রহণ করা হয় । ৩১শে জুলাই কলকাতার সবকটি কলেজের এক বিরাট ছাত্র সমাবেশে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং ছাত্রদের একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম সমিতি গঠন করা হয় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ই আগস্ট শিক্ষকদের পরিচালনায় প্রায় ৫০০০ জন ছাত্র প্রথমে কলেজ স্কোয়ারে সমবেত হয় পরে শোভাযাত্রা করে টাউন হলে জমায়েত হয় । সেদিন কলকাতার দোকান-বাজার ও যানবাহন প্রায় বন্ধ ছিল ।

বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব :

(১) ‘বয়কট’ প্রস্তাব বাংলা থেকে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে । ব্রিটিশ পণ্যসম্ভার, বিশেষ করে ম্যাঞ্চেস্টারের সুতিবস্ত্র বর্জন করার আহ্বান ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে । ছাত্ররা বিলাতি লবণ ও চিনি খরিদ করে তা নষ্ট করতে শুরু করে; শহরের বড়ো বড়ো দোকানে ছাত্রদের পিকেটিং শুরু হয় এবং ক্রেতাদের বিলাতি পণ্যসম্ভার খরিদ না করার জন্য অনুরোধ করা হয় ।

(২) বয়কট বা বর্জন নীতি সব স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করেছিল । বিলাতি পণ্যসম্ভারের বয়কট বা বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট শুরু হয় । ধোপা, নাপিত, মুচি প্রভৃতি শ্রেণির সমাজসেবীরা ইংরেজদের সবরকম সেবা করা থেকে বিরত থাকে ।

(৩) বিভিন্ন সভাসমিতিতে বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের শপথ নেওয়া হয় । শহরে এবং গ্রামেগঞ্জে প্রকাশ্যে বিদেশি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং স্বদেশি পণ্য ক্রয়ের সমারোহ শুরু হয় । এর ফলে বিলাতি পণ্যের চাহিদা বিশেষভাবে কমে যায় । ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের এক সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, এক বছরের মধ্যে বিলাতি সাবান, বিলাতি লবণ, সুতি কাপড়, বিদেশি জুতা ও সিগারেটের আমদানি অভাবনীয় ভাবে কমে গিয়েছিল ।

(৪) বয়কট আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বদেশি কুটির শিল্প ও বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে । স্বদেশি তাঁতবস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি ও চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা গড়ে ওঠে । মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন । স্বদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল স্যার জামসেদজি টাটার প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানা । এযুগে বাংলায় প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল, কারখানার প্রসার ঘটে । ডঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন । এই সঙ্গে স্বদেশি ব্যাংক, জীবনবিমা প্রভৃতির ক্ষেত্রেও বেশ উৎসাহ দেখা যায় ।

*****

Comments

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?