Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 19:10

স্বরাজ্য দল (The Swarajya Party) :

গান্ধিজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেরুয়ারি উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় একদল হিংসাত্মক জনতা এক পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশ কর্মচারীকে পুড়িয়ে মারে । এই সংবাদ শোনার পর গান্ধিজি তৎক্ষণাৎ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের আদেশ দেন । তাঁর এই আদেশে সারাদেশ স্থম্ভিত হয়ে যায় । মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হন । কেউ একে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ কেউ বা ‘পর্বত প্রমাণ ভুল’ বলে মন্তব্য করেন । তথাপি কংগ্রেস কার্য নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন ।

চৌরিচৌরার ঘটনায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহৃত হলে সারা দেশে গভীর নৈরাশ্যের সৃষ্টি হয় । জাতির সামনে নতুন কোনো কর্মসূচি না থাকায় তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েন । এদিকে খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবার ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যও ক্রমে বিলীন হয়ে যায় । মুসলমানগণ অহিংস নীতির তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পারায় সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েন । গান্ধিজি সমেত ভারতের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হওয়ায় কংগ্রেস জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিতেও ব্যর্থ হয় । এমতাবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস জেলে থেকেই আন্দোলনের নতুন কর্মপদ্ধতির কথা চিন্তা করেন । তিনি ইতিপূর্বে কংগ্রেসে গৃহীত আইনসভা বর্জনের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে অবিলম্বে আইনসভায় যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । তাঁর মতে কংগ্রেসের উচিত নির্বাচনে যোগদান করে আইনসভার সব আসন ও সেই সঙ্গে অন্যান্য স্বায়ত্ত শাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির নির্বাচিত আসনগুলি দখল করা । এভাবে সরকারি ক্ষমতা করায়ত্ত করে যথাসম্ভব গঠনমূলক কাজকর্মে ব্রতী হওয়া ও আইনসভায় অংশগ্রহণ করে নিরন্তর বাধাদানের মাধ্যমে সরকারি কাজকর্মে অচলাবস্থার সৃষ্টি করা । চিত্তরঞ্জন দাসের এই নতুন পরিকল্পনা আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি নেতাদের অনেকেরই পছন্দ হয় । অনেকে আবার পুর্ববৎ গান্ধিজির অসহযোগ নীতি চালিয়ে যাবার পক্ষপাতি ছিলেন । এ নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে দুটি গোষ্ঠির উদ্ভব হয় । যাঁরা চিত্তরঞ্জন দাসের নতুন পরিকল্পনার সমর্থক তাঁরা পরিবর্তনকামী নামে পরিচিত হলেন । মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, বিটলভাই প্যাটেল, এন. সি. কেলকার, হাকিম আজমল খাঁ, সত্যমূর্তি জয়াকর প্রমুখ এই মতের সমর্থক ছিলেন । অন্য যাঁরা এই মতের বিরোধী ছিলেন তাঁরা পরিবর্তন বিরোধী রূপে পরিচিত হলেন । চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কে. আর. আয়েঙ্গার, ডক্টর আনসারি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ নেতা এই দলে ছিলেন । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী তাঁদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন । এ নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি হয় । শেষে পরিবর্তনকামীরা তাঁদের প্রস্তাব অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হওয়ায় এই অধিবেশনের সভাপতি তথা নতুন পরিকল্পনার রূপকার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কংগ্রেস ত্যাগ করেন ও ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে 'স্বরাজ্য দল' গঠিত হয় । চিত্তরঞ্জন দাস ও মতিলাল নেহরু যথাক্রমে এর সভাপতি ও সম্পাদক নিযুক্ত হন । তারপর এই দলের সদস্যগণ সারা ভারত পরিভ্রমণ করে স্বরাজ্য দলের নীতি ও কর্মসূচি জনসমক্ষে প্রচার করেন ।

স্বরাজ্য দলের কর্মসূচি (Programme of the Swarajyists) : স্বরাজ্য দলের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ছিল—

(১) নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভায় যোগদান করে সভার কাজকর্মে অবিরাম বাধাদান করে প্রশাসনিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করা ।

(২) সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় বাজেট গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করা ।

(৩) নানা প্রকার বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি ঘটাতে সাহায্য করা ।

(৪) জাতীয় স্বার্থে নতুন অর্থনীতি রচনা করে বিদেশি অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা ।

(৫) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার লাভ করা প্রভৃতি ।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে স্বরাজ্য দল সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মধ্যপ্রদেশ ও বাংলায় সাফল্য লাভ করলেও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ৩০ জন মধ্যপন্থী মুসলিম সদস্যকে নিয়ে 'জাতীয় দল' নামে কোয়ালিশন দল গঠন করে । মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আইন সভায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের 'ভারত শাসন আইন' প্রবর্তন করে দায়িত্বশীল সরকার গঠন এবং ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার প্রস্তাব গৃহীত হয় । সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি, দমনমূলক আইন প্রত্যাহার, ভারতীয়দের দাবিগুলির বিবেচনার জন্য গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন প্রভৃতি এই দলের দাবিগুলির অন্যতম ছিল । এছাড়া দলীয় সদস্যদের ঐক্য, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দেশবাসীক মুগ্ধ করেছিল । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন দার্জিলিং -এর এক পর্যটনকেন্দ্রে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস অকালে মারা গেলে এই দলের শক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে । অতঃপর দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত স্বরাজ্য দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেও তাঁর পক্ষে দলের ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হয় নি । একক নেতৃত্বে গঠিত স্বরাজ্য দল তার নেতার মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অবলুপ্ত হয় ।

******

Related Items

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

প্রশ্ন : সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা

সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

ভারতের বিচারব্যবস্থার শীর্ষে আছে সুপ্রিমকোর্ট । এই সুপ্রিমকোর্ট একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত এবং আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে ।

রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

প্রশ্ন :  রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

(১) রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজ্যপাল । রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতা তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকে ।

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।