সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 12/05/2020 - 16:33

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে নারীরা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকর হতেন । এই সব নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম ছিল  সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ । এই প্রথা অনুযায়ী ঊনিশ শতকের সূচনালগ্নেও বাংলা তথা ভারতীয় হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তার বিধবা স্ত্রীকে নববধূর সাজে সাজিয়ে বধুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবন্ত অবস্থায় জোর করে পুড়িয়ে মারা হত । তৎকালীন হিন্দুসমাজ স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে সতীদাহ বা সহমরণের হাত থেকে রক্ষা করত না, বরং এই প্রথাকে সমর্থন করত । এই কুপ্রথাটি টিকিয়ে রাখার মূল কারণ ছিল মূলত মৃতের পরিবারের সম্পত্তি গ্রাস করা । সাধারণত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, মাহিষ্য তথাকথিত সমাজের উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সতী হওয়ার ঘটনা বেশি ছিল । ব্রিটিশ সরকার এই বর্বর কুপ্রথার বিরোধী ছিল, কিন্তু প্রথম দিকে সরকার এই প্রথা নিষিদ্ধ করে হিন্দুসমাজকে ক্ষিপ্ত করে তাদের বিরাগভাজন হতে চায়নি । ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে নিজামত আদালতের পণ্ডিত ঘনশ্যাম শর্মা সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে প্রথম মতামত জানান । তাঁর মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার সতীদাহ প্রথাকে হিন্দু শাস্ত্রসম্মত আচার বলে স্বীকার করে নেয় ও সতীপ্রথা সম্পর্কে কিছু নির্দেশ জারি করে । এই নির্দেশে বলা হয় (i) সতী হওয়ার জন্য জোর করা যাবে না, (ii) যে সতী হবে তার বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর হতে হবে, (iii) গর্ভবতী নারী বা শিশুপুত্রের মাতা সতী হতে পারবেন না, (iv) সতী হতে গেলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন প্রয়োজন । এই নির্দেশগুলি জারির দু-বছর পরে নিজামত আদালতের তরফে জানানো হয় যে তিন বছরের কম বয়সী শিশু থাকলে তার উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে তবেই তার মা সতী হতে পারবে ।

সতীপ্রথাকে কেন্দ্র করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলকাতার শিক্ষিত মহলে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয় । সতীপ্রথার কুফল সম্পর্কে অবহিত হয়ে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি জন আনস্ট্রুথার কলকাতার মধ্যে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন । কলকাতায় এই প্রথা বন্ধ হলেও মার্শম্যানের বিবরণ থেকে জানা যায় যে অন্যত্র সতীপ্রথার চল ছিল । ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা সতীপ্রাথার বিরোধিতা করে 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করে । শ্রীরামপুর মিশনারিরা সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রথা যে শাস্ত্রসম্মত নয় তা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন । সতীপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁরা ইংল্যান্ডেও জনমত গঠনের চেষ্টা চালান । শ্রীরামপুরের মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে এই কুপ্রথা বন্ধের জন্য উদ্যোগী হতে বলেন ।

বাংলার সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।  তিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য প্রকৃত অর্থেই এক আন্দোলন গড়ে তোলেন । রাজা রামমোহন রায় 'আত্মীয় সভা' প্রতিষ্ঠা করে সতীপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন । সতীপ্রথা যে শাস্ত্রসম্মত নয় তা ব্যাখ্যা করে সতীপ্রথার ওপর রামমোহন একটি বই লেখেন । রক্ষণশীল সমাজও রক্ষণশীলদের পত্রিকা 'সমাচার চন্দ্রিকা'য় সতীপ্রথার সমর্থনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন । রামমোহন তাঁর 'সম্বাদ কৌমুদী' পত্রিকায় রক্ষণশীলদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন । রামমোহন বিভিন্ন স্মৃতিকারদের উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রমাণ করেন যে সতীপ্রথা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয় । সতী সম্পর্কিত দ্বিতীয় পুস্তিকায় রামমোহন স্মৃতিশাস্ত্র, বেদ, পুরাণ থেকে অজস্র উদ্ধৃতি আলোচনা করে রক্ষণশীলদের মতামতকে নস্যাৎ করেন । এই কুপ্রথা বন্ধের আবেদন জানিয়ে রামমোহন লর্ড উয়িলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন । এই আবেদনপত্রে তৎকালীন বাংলার ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিক স্বাক্ষর করেন । গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন ও ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন জারির দ্বারা সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।

******

Comments

Related Items

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Kashmir):-

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দু

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Hyderabad):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে ।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪)

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) [Post-Colonial India : Second Half od the 20th Century (1947-1964)]:-

দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মবলিদানের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন

হিন্দু জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার উল্লেখযোগ্য দলিত হিন্দু সম্প্রদায় । নমঃশূদ্ররা হিন্দু জাতিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত । নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । ...