সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ (Millitant Nationalism) :
স্বদেশের তথা মাতৃভূমির গৌরব ও অগৌরবকে কেন্দ্র করে সেই দেশের মানুষ বা জাতির অন্তরে যে উল্লাস, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, অনুভূতি, জাতীয় চেতনা, আত্মমর্যাদা ও আত্মাভিমান সঞ্চারিত হয় তাকেই জাতীয়তাবাদ বলে । জাতীয়তাবাদ যখন সংগ্রামী রূপ ধারণ করে তখন তাকে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ বলে ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতকের শুরুতে ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কথা ছিল স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার । দয়া ভিক্ষা করে স্বাধীনতা লাভ করা যায় না । দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও আত্মশক্তির দ্বারাই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় । পরাধীন ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তিনটি ধারায় পরিচালিত হয়, যথা—
(১) আত্মশক্তির আদর্শ বা স্বদেশি আন্দোলন,
(২) নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন বা বয়কট এবং
(৩) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ (Causes of the Growth of Millitant Nationalism) :
(ক) অর্থনৈতিক শোষণ (Economical Exploitation) :- ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের অন্যতম কারণ ছিল । ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের শুল্ক সংক্রান্ত আইন ও ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের কার্পাসবস্ত্র আইনের ফলে ভারতের বস্ত্রশিল্প ও বণিকরা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তাছাড়া উচ্চহারে ভুমিরাজস্ব ধার্য, শ্রমিকদের স্বল্প বেতন, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় সরকারের দায়িত্বহীনতা ইত্যাদির জন্য ব্রিটিশকেই দায়ী করা হয় । এদেশে আইন কানুন সবই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ছিল । ফলে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার সীমা ছিল না । ভারতবাসীর ক্রমপুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রতিকারের পথ না পেয়ে পরিশেষে প্রতিবাদের পথ খুঁজে নেয় । সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ তাঁরই পরিণত রূপ ।
(খ) সরকারি দমননীতি (True Nature of British Rule) :- সাম্রাজ্যবাদী শাসক লর্ড লিটন -এর সময় থেকে বিভিন্ন দমন আইন, লর্ড কার্জনের 'মিউনিসিপ্যাল আইন', 'ইউনিভার্সিটি আইন' ইত্যাদি জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ ভারতবাসীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয় । ক্রমপুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ কালক্রমে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয় ।
(গ) সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী (Contemporary International Events) : সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এবং তার প্রতিক্রিয়া ভারতবাসীকে সংগ্রামমুখী করে তুলেছিল । ব্রিটেন ও ইটালির বিরুদ্ধে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদীদের সংগ্রাম ও তার সাফল্য, রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের মতো ছোট দেশের কাছে রাশিয়ার মতো বিশাল দেশের পরাজয় ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি থেকে ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপরাজেয় নয় । এই ধারণা ও আত্মবিশ্বাস ভারতবাসীকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে তোলে ।
(ঘ) নরমপন্থীদের ব্যর্থতা (Failure of the Moderates) : ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদি পর্বে অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম কুড়ি বছরে গৃহীত নীতি, কর্মপন্থা, নরমপন্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ভারতবাসীর অভাব অভিযোগ পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের ব্যর্থতা চরমপন্থী নেতৃবৃন্দকে সংগ্রামমুখী করে তুলেছিল । এই সময়কার জাতীয় আন্দোলন দু-ধারায় পরিচালিত হয়েছিল— একটি চরমপন্থীদের নেতৃত্বে চরমপন্থী আন্দোলন, অন্যটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন । কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ বা চরমপন্থী মতবাদ ছিল অত্যাধিক ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের অন্তরায় । তাঁরা এজন্য গঙ্গাস্নান, রাখিবন্ধন, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের পরিকল্পনা এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের দেশকে দেশ-মাতৃকারূপে ভাবনার ঘোর বিরোধী হয়ে পড়েন । এঁরা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করেই দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন । তাঁদের চিন্তা ধ্যানধারণার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভাবনার লেশমাত্র ছিল না । এ বিষয়ে সোভিয়েত ঐতিহাসিক কোমারভের মতে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভিত্তি করেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন । আনন্দমঠের পরিকল্পনা, বন্দেমাতরম, রাখিবন্ধন কিংবা তিলকের 'শিবাজি ও গণপতি' উৎসব জাতীয় আবেগের অন্য এক নাম । সুতরাং সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ভুমিকা থাকলেও ভারতের নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদকে রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট জাতীয়তাবাদ বলে ব্যাখ্যা করা সমীচীন নয় । বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, তিলক, অরবিন্দ প্রমুখ মনীষীবৃন্দ সাম্প্রদায়িকতার বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন । তাঁদের ভাবনায় সবার ঊর্ধ্বে ছিল দেশ, দেশবাসী এবং তাদের স্বাধীনতা ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ।
(ঙ) আদর্শগত কারণ (Neo-Hinduism) : ভারতবর্ষে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূলে আদর্শগত কারণ অন্যতম । ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের পিছনে যেমন দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল, ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূলে তেমনই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পরোক্ষ অবদান ছিল । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠে সন্তান দলের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের আদর্শ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল । আনন্দমঠে সন্তান দলের উচ্চারিত বন্দেমাতরম মন্ত্র পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জাতীয় মুক্তি মন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছিল । তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক অবক্ষয় ও নীতি হীনতাই ভারতবাসীর পরাধীনতার মূল কারণ । ভারতবাসীকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য । তাই তিনি জাতিকে দিয়েছিলেন দেশকে ভালবাসার, দেশের মুক্তি মন্ত্র 'বন্দেমাতরম' । স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শে পরিণত করেন । তিনি বলতেন "দুর্বলতাই হল দাসত্বের নামান্তর, দুর্বলতাই হল মৃত্যু " । তাই তিনি ভারতীয় যুব সমাজকে দৈহিক ও মানসিক বলে বলীয়ান হয়ে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মোৎসর্গের আহ্বান জানিয়েছিলেন । ভারতীয় যুবক বৃন্দের প্রতি তাঁর উদাত্ত আহ্বান— 'ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত' বহুলাংশে ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল । পরবর্তীকালে শ্রীঅরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতা স্বামী বিবেকানন্দের ধ্যান ধারণা ও স্বদেশ মন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । সন্ন্যাসী হয়েও তিনি ছিলেন অগণিত বিপ্লবীর প্রেরণার উৎস । স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ধর্মীয় মতবাদ ও সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারে সহায়ক হয়েছিল ।
*****
- 3729 views