Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 01/08/2022 - 08:54

প্রশ্ন:- মহাবিদ্রোহের বিস্তার ও প্রকৃতি আলোচনা কর ।

মহাবিদ্রোহের বিস্তার :

(১) সিপাহি বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে কলকাতার উত্তরে ব্যারাকপুরে ।

(২) এই বিদ্রোহের সংবাদ লক্ষ্ণৌ -এর সিপাহিদেরও সংক্রামিত করেছিল ।

(৩) লক্ষ্ণৌ -এর পরে বিদ্রোহ মীরাটে প্রসারিত হয় ।

(৪) মিরাট থেকে এই বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে দিল্লিতে ছড়িয়ে পড়ে । দিল্লিতে সিপাহিরা স্ত্রী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে ইংরেজদের হত্যা করে ।

(৫) এরপর বিদ্রোহ গাঙ্গেয় প্রদেশগুলিতে ও মধ্যভারতে ছড়িয়ে পড়ে । ফিরোজপুর, মজফ্‌ফর নগর ও আলিগড়ে সিপাহিরা বিদ্রোহী হয় ।

(৬) এরপর পাঞ্জাবের অন্তর্গত নৌসরা ও হতমর্দনেও বিদ্রোহ সংক্রমিত হয় । অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে । অযোধ্যার সম্পত্তিচ্যুত তালুকদাররা বিদ্রোহে যোগ দেন ।

(৭) রোহিলাখন্ডের পূর্বতন সর্দাররা এই বিদ্রোহে যোগ দেন । এদের মধ্যে বেরিলির খান বাহাদুর, নাজিরাবাদের মহম্মদ খাঁ, গোরখপুরের মহম্মদ হাসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।

(৮) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলার চট্টগ্রামের সিপাহিরা বিদ্রোহী হন । কিন্তু সেখানে জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় সিপাহিরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ।

(৯) নর্মদা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি একরকম অক্ষুন্নই ছিল, যদিও সিপাহিদের মধ্যে উত্তেজনার অভাব ছিল না ।

(১০) রাজস্থানেও বিদ্রোহ সংক্রামিত হয় । কিন্তু রাজপুত শাসকরা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকায় সেখানে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে নি ।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বাদানুবাদের অন্ত নেই । বিদ্রোহের সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে নানা ধরনের মতামত উপস্থাপিত হয়েছে । উপস্থাপিত এই মতামতগুলি ব্যাখ্যাকালে যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, তা হল এই বিদ্রোহ কি নিছক সিপাহি বিদ্রোহ ছিল ? অথবা, এই বিদ্রোহ কী জাতীয় বিদ্রোহের মর্যাদা পেতে পারে ?

আলোচনার সুবিধার্থে এই মতামতগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, যেমন—

ম্যালেসন, জন কে, স্যার জন লরেন্স, রবাটর্স প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিপাহি বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কিছু মনে করেন না । বামপন্থী চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত এই বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরোধী মতামত বিশ্লেষণের শেষে একথা বলা যায় যে, এই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে কোনও বিশেষ মতামতটি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বা ভিত্তিহীন বলা যায় না । আসলে প্রত্যেকটি মতে কিছু না কিছু সত্যি উন্মোচিত হয়েছে । তবে এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বেলি (C.A Bayly) বলেছেন ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কেবলমাত্র একটি আন্দোলন নয় । এটাকে কৃষক বিদ্রোহ বলা যেতে পারে অথবা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বা অন্যকিছু’ ।

*****

Comments

Related Items

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (Sanyasi-Fakir Rebellion):- ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় ১৭৬৩ থেকে ১৮০০  খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'গিরি' ও 'দাশনামী' সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী ও 'মাদারী' সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষকবিদ্রোহ

পাগলপন্থী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব ১৮২৫ - ২৭ খ্রিস্টাব্দে)

পাগলপন্থী বিদ্রোহ (Pagal Panthi Revolt) : ঊনিশ শতকে বাংলায় যেসব কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলির মধ্যে 'পাগলপন্থী' বিদ্রোহ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল । ঔপনিবেশিক শাসনকালে অবিভক্ত বাংলায় ময়মনসিং জেলার শেরপুর পরগনার পাহাড়ি এলাকায় গারো ও

মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে)

মুন্ডা বিদ্রোহ (Munda Rebellion):- বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচিসহ ছোটোনাগপুর অঞ্চলে এবং তৎসংলগ্ন মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও বাংলার একাংশে মুন্ডা উপজাতিরা বসবাস করত । ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাঁচিতে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিরসা মুন্ডার নেতৃ

সাঁওতাল হুল (১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)

সাঁওতাল বিদ্রোহ (Santhal rebellion) : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে যে সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহগুলি ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' বা 'সাঁওতাল হুল' সবথেকে ভয়াবহ ও জঙ্গি ছিল । সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলা হয় । সাঁওতালগণ

কোল বিদ্রোহ (১৮৩১ -৩২ খ্রিস্টাব্দ)

কোল বিদ্রোহ (Kol Rebellion) : উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে, তাদের মধ্যে কোল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম । বিহারের ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালে কোল উপজাতি গোষ্ঠী বসবাস করত । কোল উপজাতি গোষ্