বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা - মহারাষ্ট্র

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 10:56

বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা - মহারাষ্ট্র (Revolutionary Activities in Maharashtra) :

সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে (Wasudeo Balwant Phadke) সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করবার প্রচেষ্টা করেছিলেন । ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলার শিরধন গ্রামে চিত্পাবন গোষ্ঠির ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । ভারতীয় সরকারি কর্মচারীদের প্রতি ইংরেজদের উদ্ধত আচরণ এবং অবজ্ঞার মনোভাব লক্ষ্য করে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে প্রথম জীবনেই ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন । ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করাই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান । তাই তিনিই প্রথম ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানকল্পে বিপ্লবী সমিতি গঠন করেছিলন । শিবাজীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনি 'রামোসিস' সম্প্রদায়ের যুবকদের নিয়ে এক বিপ্লবী দল গঠন করেন । পরে রামোসিসদের উচ্চাশার কারণে তিনি এই দল ভেঙ্গে দিয়ে ইসমাইল খাঁর সহায়তায় পাঁচশো রোহিলা অনুচর সংগ্রহ করে তাদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেন । কিন্তু অচিরেই তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে এডেনে নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানে ক্ষয়রোগে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারী তাঁর জীবনান্ত হয় । আপোষহীন মনোভাব ও উদগ্র স্বাধীনতা প্রীতির জন্য ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কেকে ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের জনক আখ্যায় ভূষিত করেন ।

বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের মৃত্যুর পর মহারাষ্ট্রে অল্পকাল সশস্ত্র আন্দোলন স্তব্দ থাকে । তারপর লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর দুই সাপ্তাহিক পত্রিকা 'মারাঠি' এবং 'কেশরী' -তে নির্ভীক লেখনীর দ্বারা শিক্ষিত যুবকদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিতভাবে শক্তিশালী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন । তাছাড়া মারাঠাদের মধ্যে আত্মত্যাগ, স্বদেশপ্রীতি ও শিবাজির আদর্শ তুলে ধরতে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে 'সর্বজনীন গণপতি উৎসব' ও ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে 'শিবাজি উৎসব' পালন করেছিলেন । লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের প্রেরণায় ও বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের আদর্শে এই সময় 'বাল সমাজ' ও 'আর্যবান্ধব সমাজ' গঠিত হয়েছিল । প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম থেকে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে 'বাল সমাজ' গড়ে ওঠে । আর সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবলুপ্তি ঘটানোই ছিল 'আর্যবান্ধব সমাজ' -র লক্ষ্য । 

বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তিন চাপেকর ভাই দামোদর চাপেকর, বালকৃষ্ণ চাপেকরবাসুদেব চাপেকর ইংরেজ নিধনে ব্রতী হন । ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ রোগ নিবারণের অজুহাতে পুণাতে নিরীহ জনসাধারণের ওপর প্লেগ কমিশনার মিঃ র‍্যান্ড যে অত্যাচার করেছিলেন তাঁর প্রতিশোধ নেবার জন্য দামোদর চাপেকর ও বালকৃষ্ণ চাপেকর তাঁকে এবং সহযোগী আয়ার্স্টকে গুলি করে হত্যা করেন । দুই ডেভিড ভাই এঁদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলে বাসুদেব চাপেকর এবং তাঁর বন্ধু রাণাডে দুই ডেভিড ভাইকে হত্যা করেন । রাণাডে সহ তিন চাপেকর ভাই দামোদর চাপেকর, বালকৃষ্ণ চাপেকর ও বাসুদেব চাপেকর পুলিশের হাতে বন্দী হয়ে আদালতে অভিযুক্ত হন ও বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় ।

সাভারকর ভ্রাতৃত্রয় (Savarkar Brothers) :

চাপেকর ভাইদের আত্মদানের পর মহারাষ্ট্রে বিপ্লবের ধারা অক্ষুন্ন রাখেন তিন সাভারকর ভাই গনেশ দামোদর সাভারকর, বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং নারায়ণ দামোদর সাভারকর । চাপেকর ভাইদের মৃত্যুদন্ড ১৫ বছরের কিশোর বিনায়কের মনে এমন তীব্র রেখাপাত করেছিল যে তিনি সেই অল্প বয়সেই গৃহদেবতার সামনে এর প্রতিশোধ নেবার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গনেশ দামোদর সাভারকরের সহায়তায় 'মিত্রমেলা' নামে একটি গোপন বিপ্লবী সমিতি গঠন করেন । ভারতে বিপ্লব অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশকে পর শাসন মুক্ত করাই ছিল 'মিত্রমেলা' -র উদ্দেশ্য । পরে বিনায়ক দামোদর সাভারকর লন্ডনে চলে গেলে তাঁর দাদা গনেশ দামোদর সাভারকর ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইটালির জননেতা ম্যাৎসিনির 'ইয়ং ইটালি' ও 'কার্বোনারি' দলের অনুকরণে নাসিকে 'অভিনব ভারত' নামে একটি গুপ্ত সমিতি গঠন করেন । তখন থেকেই 'মিত্রমেলা' 'অভিনব ভারত' নামে পরিচিত হয় । এই সভার সদস্যগণ তরুণ ইটালির এবং তার নেতা ম্যাৎসিনীর আদর্শে নিজেদের সংগঠিত করেছিলেন । বিনায়ক দামোদর সাভারকর ছিলেন এঁদের অবিসম্বাদিত নেতা । বিনায়ক দামোদর সাভারকর লন্ডন থেকে ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য নিয়মিত অস্ত্র পাঠাতে শুরু করেন । মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান সহ হায়দরাবাদ, ঔরঙ্গবাদ, সাতারায় 'অভিনব ভারত' -র শাখা কেন্দ্র স্থাপিত হয় । গণেশ দামোদর সাভারকরের উদ্যোগে বোমা তৈরির কলাকৌশল শিখে আসার জন্য পি. এম. বাপাতকে প্যারিসে পাঠানো হয় । 

কোলাপুর বোমার মামলা (Kolapur Conspiracy Case) :

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা জুলাই মদনলাল ধিংড়া লন্ডনের এক পার্কে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের পরিকল্পনা মতো স্যার কার্জন ওয়াইলিকে হত্যা করেন এবং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই আগস্ট তিনি ইংল্যান্ডে ফাঁসির কাঠে মৃত্যুবরণ করেন । মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য তাঁরা গণেশ দামোদর সাভারকরকে গ্রেপ্তার করে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন । আদালতে অভিযুক্ত হয়ে গণেশ দামোদর সাভারকর যাবজ্জীবন কারাদন্ডে নির্বাসিত হন । এরই প্রতিক্রিয়ায় গণেশ দামোদর সাভারকরের দন্ডদাতা নাসিকের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. জ্যাকসনকে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর অনন্ত লক্ষ্মন কানহেরে গুলি করে হত্যা করেন । এই খুনকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় । তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় কোলাপুর বোমার মামলা । এই মামলায় অভিযুক্তদের দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড হয় । ওদিকে লন্ডনে বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে গ্রেপ্তার করে বিচারের জন্য ভারতে পাঠানো হয় । তাঁকে সরকারের বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আদালতে অভিযুক্ত করে নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় । নাসিক মামলার বিচারের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অনন্ত লক্ষ্মণ কানহেরে, কৃষ্ণগোপাল কার্ভে ও নারায়ণ দেশপান্ডের ফাঁসি হয় । বিনায়ক দামোদর সাভারকর ২৬ বছরের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন । তবে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কারামুক্ত হয়েছিলেন ।

অভিনব ভারত (Avinava Bharat) :

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গনেশ দামোদর সাভারকরের সহায়তায় 'মিত্রমেলা' নামে একটি গোপন বিপ্লবী সমিতি গঠন করেন । পরে বিনায়ক দামোদর সাভারকর লন্ডনে চলে গেলে তাঁর দাদা গনেশ দামোদর সাভারকর ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইটালির জননেতা ম্যাৎসিনির 'ইয়ং ইটালি' ও 'কার্বোনারি' দলের অনুকরণে নাসিকে 'অভিনব ভারত' নামে একটি গুপ্ত সমিতি গঠন করেন । তখন থেকেই 'মিত্রমেলা' 'অভিনব ভারত' নামে পরিচিত হয় । মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান সহ হায়দরাবাদ, ঔরঙ্গবাদ, সাতারায় 'অভিনব ভারত' -র শাখা কেন্দ্র স্থাপিত হয় । আচার্য কৃপালনি এবং বি.জে. খের এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।

(১) এই সভার সদস্যগণ তরুণ ইটালির এবং তার নেতা ম্যাৎসিনীর আদর্শে নিজেদের সংগঠিত করেছিলেন ।

(২) ভারতে বিপ্লব অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশকে পরশাসন মুক্ত করাই ছিল এই গোপন বিপ্লবী সমিতি -র উদ্দেশ্য ।

(৩) বিনায়ক দামোদর সাভারকর ছিলেন এঁদের অবিসম্বাদিত নেতা ।

(৪) এই সংস্থা শরীরচর্চা, লাঠি ও তরবারি খেলা, পাহাড়ে ওঠা, ঘোড়ায় চড়া প্রভৃতি দুঃসাহসিক কাজকর্মের শিক্ষা দিত ।

(৫) বোম্বাই ও পুণার প্রতিটি কলেজে এই সংস্থার গোপন শাখা স্থাপিত হয় । বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বৈপ্লবিক আদর্শ ও চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়া ছিল এই সমিতির প্রধান কাজ ।

(৬) অস্ত্র সংগ্রহ ছিল সংঘের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি । ইতিমধ্যে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য গণেশ সাভারকর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ।

(৭) পরবর্তীকালে এই সমিতির সদস্যরা নাসিকের ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে হত্যা করে । এই উপলক্ষ্যে ‘নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায়’ বিপ্লবীদের অভিযুক্ত করা হয় ।

বিপ্লবী আন্দোলনে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা (Role of Vinayak Damodar Savarkar in Revolutionary Activities) :

(১) মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর ।

(২) তিনি ‘মিত্রমেলা’ নামে এক সমিতি গঠন করে তরুণদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াসী হন । তরুণদের অস্ত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি যত্নশীল ছিলেন ।

(৩) ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘অভিনব ভারত’ নামে এক বিপ্লবী  সমিতি গঠন করে ভারতের নানা স্থানে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দেন ।

(৪) বিনায়ক দামোদর সাভারকর লন্ডন থেকে ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য নিয়মিত অস্ত্র পাঠাতে শুরু করেন ।

(৫) ইতিমধ্যে তাঁর অনুগামী মদনলাল ধিংড়া ইংল্যান্ডে স্যার কার্জন ওয়াইলি হত্যা করেন । এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে গ্রেফতার করা হয় । বিচারে বিনায়ক দামোদর সাভারকর ২৬ বছরের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন । তবে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কারামুক্ত হয়েছিলেন ।

(৬) কারাবাসের পর তিনি মুক্ত হলে তাঁকে “বীর সাভারকর’ আখ্যা দেওয়া হয় ।

*******

 

 

Related Items

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

প্রশ্ন : সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা

সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

ভারতের বিচারব্যবস্থার শীর্ষে আছে সুপ্রিমকোর্ট । এই সুপ্রিমকোর্ট একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত এবং আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে ।

রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

প্রশ্ন :  রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

(১) রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজ্যপাল । রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতা তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকে ।

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।