Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 01/12/2021 - 11:28

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ (Development of Science and Technical Education in Bengal):-

ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের বিভিন্ন অফিস-আদালত প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কাজের প্রয়োজনে আধুনিক পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়োজন হয় । এই প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সূচনা ঘটালে বাঙালির একাংশ উদ্বুদ্ধ হয়ে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা শুরু করে । তখন থেকেই বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ শুরু হয় । কায়েমী স্বার্থরক্ষাকারী ও প্রভূত্ববাদী ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানচর্চার প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা সম্প্রসারণ এবং জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার নির্মাণে যে সমস্ত ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, শিশির কুমার মিত্র, উপেন্দ্র ব্রহ্মচারী, দেবেন্দ্রমোহন বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, মেঘনাথ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন ।

কলকাতা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় এম. ডি. ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার অ্যালোপ্যাথির ডাক্তার হলেও অচিরেই হোমিওপ্যাথির একজন অগ্রগণ্য ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন । তিনি কেশবচন্দ্র সেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস প্রমূখ ব্যক্তিবর্গের চিকিৎসাও করেছিলেন । তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল, ফাদার লাঁফো, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ ব্যক্তির সহযোগিতায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে মহেন্দ্রলাল সরকার বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে বৌবাজার স্ট্রীটে প্রথম 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স' (IACS) প্রতিষ্ঠা করেন । পরে এখানে আধুনিক লেকচার থিয়েটার হল এবং বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়েছিল । এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যায় ফাদার লাঁফো, ডঃ সরকার স্বয়ং এবং পরে জগদীশচন্দ্র বোস, রসায়নে কানাইলাল দে, গণিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ভূতত্ত্বে প্রমথনাথ বসু, জীববিজ্ঞানে নীলরতন সরকার এর মত দিকপাল পণ্ডিতেরা শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন । সি.ভি. রমন এখানে গবেষণা করেন এবং তাঁর বিখ্যাত রমন ক্রিয়া -র জন্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কে.এস. কৃষ্ণন 'Crystal Magnetism' -এর ওপর গবেষণা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন ।

প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর 'এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি' গ্রন্থে বৈদিক যুগ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে রসায়ন চর্চার বিবরণ দেন । প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি গড়ে ওঠে । ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড' প্রতিষ্ঠা করেন । প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অধীনে রসিকলাল দত্ত এবং হেমেন্দ্রকুমার সেন রসায়নচর্চাকে কে এগিয়ে নিয়ে যান । প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র নীলরতন ধর আবর্জনা থেকে তৈরি সার মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে, তা প্রমাণ করেন ।

দেশীয় বিজ্ঞানচর্চার লক্ষ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র বসু 'বসুবিজ্ঞান মন্দির' নামে গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি বিশ্বে প্রথম বেতার যন্ত্রে সংবাদ পাঠানোর যন্ত্র (কোহেরা) আবিষ্কার করলেও এই আবিষ্কারের সম্মান পান গুলিয়েলমো মার্কনি । সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মহল জগদীশচন্দ্রকে মরণোত্তর বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের সূত্র নির্মাতার সম্মান দিয়েছে । জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদবিদ্যা কেন্দ্রিক গবেষণায় ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন যে 'গাছের প্রাণ আছে' । পদার্থবিদ্যা বিষয়ক গবেষনায় শিশিরকুমার মিত্রের 'Upper Atmosphere' এর তথ্য দেশে-বিদেশে সমাদরে গৃহিত হয় । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় । জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবেন্দ্রমোহন বসুর গবেষণা 'মেঘকক্ষ' পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে । তিনি মহাজাগতিক রশ্মি, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা এবং নিউট্রন পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেন । জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ গাঢ় দ্রবণের ভেতরে লবণের অণুগুলি কীভাবে আয়নিত হয়ে বিদ্যুৎ পরিবহন করে তার ওপর গবেষণা করেন । তাঁর এই তত্ত্ব 'ঘোষের আয়নবাদ' নামে বিখ্যাত । ফোটো কেমিস্ট্রির ওপর তাঁর গবেষণা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখেন । তিনি প্রমাণ করেন যে সূর্যের বাতাবরণ উত্তপ্ত গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা তৈরি ও এই উত্তপ্ত গ্যাসীয় পদার্থের প্রচন্ড গতিশীল পরমাণুগুলির সংঘর্ষের ফলে বেশকিছু পরমাণু থেকে ইলেকট্রন কণা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ফলে ওই সমস্ত পরমাণু আয়নে পরিণত হয় । এ ছাড়া তিনি সূর্যের আবহমন্ডলে বিভিন্ন ধরনের গ্যাসীয় উপাদানগুলির সঠিক অনুপাত নির্ণয় করেন । সত্যেন্দ্রনাথ বসু আলোককণিকাদের বিশেষ গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করে প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারণ করেন । তিনি গণনা করে বলেন, একই শক্তির আলোককণিকাগুলির মধ্যে পার্থক্য করা যায় না এবং সাধারণ বস্তু কণিকাগুলি একই রূপের হলেও পার্থক্যহীন নয় । তাঁর এই গণনা পদ্ধতির নাম বোস স্ট্যাটিসটিক্স বা বোস সংখ্যায়ন ।

******

Comments

Related Items

ইতিহাসের ধারণা ও আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য

ইতিহাসের ধারণা :- ইতিহাস কথাটির অর্থ হল অতীতে যা ঘটেছে তার বিবরণ । সুদুর অতীত, নিকট অতীত, এমনটি গতকালের ঘটনাও অতীত । সুদুর অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শুরু করে গতকালের ঘটনাও ইতিহাসের বিষয়বস্তু । ঐতিহাসিক তাঁর ব্যক্তিগত অনুভব এবং বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করেন ।

Answer for Madhyamik Examination (WBBSE) - History 2017 (Bengali version)

১. সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো : ১x২০=২০ ১.১ ভারতে ফুটবল খেলা প্রবর্তন করেন— (ক) ইংরেজরা (খ) ওলন্দাজরা (গ) ফরাসিরা (ঘ) পোর্তুগিজরা

Answer for Madhyamik Examination (WBBSE) - History 2019 (Bengali version)

১। সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো : ২০ x ১ = ২০ ১.১ মোহনবাগান ক্লাব আই.এফ.এ. শিল্ড জয় করেছিল— (ক) ১৮৯০ খ্রিঃ (খ) ১৯০৫ খ্রিঃ (গ) ১৯১১ খ্রিঃ (ঘ) ১৯১৭ খ্রিঃ

Madhyamik Examination (WBBSE) - 2019 History (Bengali version)

১.১ মোহনবাগান ক্লাব আই.এফ.এ. শিল্ড জয় করেছিল— (ক) ১৮৯০ খ্রিঃ (খ) ১৯০৫ খ্রিঃ (গ) ১৯১১ খ্রিঃ (ঘ) ১৯১৭ খ্রিঃ ১.২ দাদাসাহেব ফালকে যুক্ত ছিলেন— (ক) চলচ্চিত্রের সঙ্গে (খ) ক্রীড়া জগতের সঙ্গে (গ) স্থানীয় ইতিহাসচর্চার সঙ্গে (ঘ) পরিবেশের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে

Madhyamik Examination (WBBSE) - 2017 History (Bengali version)

বিভাগ—ক ১. সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো : ১x২০=২০ ১.১ ভারতে ফুটবল খেলা প্রবর্তন করেন— (ক) ইংরেজরা (খ) ওলন্দাজরা (গ) ফরাসিরা (ঘ) পোর্তুগিজরা ১.২ বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন—