Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 18:19

ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement)

ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement) : ঊনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফরাজি আন্দোলন । 'ফরাজি' শব্দটি আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে এসেছে । ফরজ শব্দের অর্থ হল 'আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত বাধ্যতামূলক কর্তব্য' । ইসলাম ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ' ফরাজি' নামে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে 'দার-উল-হারব' বা 'শত্রুর দেশ' রূপে চিহ্নিত করে বলেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মুসলিমদের বসবাসের যোগ্য নয় । সমস্ত মুসলমানকে তিনি ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শ মেনে চলার জন্য আবেদন জানান । কোরানের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে তিনি কলমা (আল্লার প্রতি বিশ্বাস), নামাজ (আল্লার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা), রোজা (উপবাস), হজ (তীর্থযাত্রা) ইত্যাদি ধর্মাচরণের নির্দেশ দেন । হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ কুসংস্কারমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ গঠনের কথা বলতেন । বাংলার নিপীড়িত ও অত্যাচারিত মানুষের কাছে হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ছিলেন এক আদর্শ পুরুষ । ফরাজি আন্দোলনের মূল প্রবর্তক হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ -র মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, যশোহর, নোয়াখালি, বাখরগঞ্জ ইত্যাদি জেলার অজস্র মুসলিম চাষি কারিগর ও বেকার তাঁতি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ।

হাজি শরীয়ৎ উল্লাহ তাঁর অনুগামীদের জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেন । এই আন্দোলন ফরিদপুর জেলায় শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর, চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ মারা গেলে তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এই আন্দোলনের হাল ধরেন । দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করেন । জমিদার, নীলকর ও সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর স্লোগান ছিল 'যারা জমি চাষ করছে জমি তাদেরই' অথবা 'জমির মালিক ঈশ্বর' । তিনি ফরাজি খিলাফৎ নামে এক সংগঠন গড়ে তোলেন, যার শীর্ষে অবস্থানকারীকে ওস্তাদ এবং তাঁর সাহায্যকারীকে খলিফা বলা হত । তিনি তাঁর প্রভাবাধীন বাংলার এলাকাগুলিকে কয়েকটি হল্কা বা অঞ্চলে ভাগ করেন । ৩০০ থেকে ৫০০ ফরাজি পরিবার বসবাসকারী অঞ্চলে তিনি একজন করে খলিফা নিয়োগ করেন । খলিফাদের দায়িত্ব ছিল নিজ নিজ এলাকার কৃষকদের জোটবদ্ধ করা, জমিদার ও নীলকরদের অন্যায়-অত্যাচার প্রতিরোধ করা এবং অর্থ জোগাড় করা । তিনি তাঁর অনুগামীদের প্রতি জমিদারদের খাজনা না দেওয়ার, নীলকরদের নীলচাষ না করার এবং ব্রিটিশদের অমান্য করার আহ্বান জানান । দুদু মিঞা একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী ও গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তুলে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বাসভবন আক্রমণ করেন ।

১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঢাকা, পাবনা, বাখরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, খুলনা ছাড়াও তার প্রভাবে এপার বাংলার ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ফরাজি আন্দোলনের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে । ক্রমে ফরাজি আন্দোলন তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারায় । জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং দল ভুক্তির জন্য এই আন্দোলনের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে । ফরাজিরা ফরিদপুরের পাঁচচরে ডানলপ সাহেবের নীলকুঠিতে আগুন লাগিয়ে দেয় । তারা ডানলপের গোমস্তা কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলালকে হত্যা করে । জমিদার ও নীলকর সাহেবরা জোট বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন । শেষ পর্যন্ত জমিদার ও নীলকর সাহেবদের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে দুদু মিঞাকে কারারুদ্ধ করেন । করারুদ্ধ অবস্থায় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর দুদু মিঞার মৃত্যু হলে সাময়িকভাবে ফরাজি আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে ।

দুদু মিঞার মৃত্যুর পর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা যাঁর আসল নাম আবদুল গফুর ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন । তাঁর নেতৃত্বে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলন চলে । নোয়া মিঞা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে ধর্মীয় কর্মসূচির ওপর বিশেষ জোর দেন । সেই কারণে বহু হিন্দু অনুগামী ফরাজি আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায় । এর ফলে ফরাজি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে । শেষপর্যন্ত ফরাজিরা এক সংকীর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয় ।

বৈশিষ্ট্য :- ফরাজি আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল—

(১) এটি ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও তা শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন হয়ে ওঠে ।

(২) এর সাম্প্রদায়িক বিরোধী বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে, কেন না এতে হিন্দু মুসলমানের আংশিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।

(৩) এই ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে পুনরুজ্জীবনবাদী সংস্কারপন্থী বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে । কারণ ফরাজি আন্দোলন প্রথমদিকে ইসলামের পুনরুজ্জীবনে র লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল ।

(৪) ফরাজি আন্দোলন সার্বিক বিচারে এক বৈপ্লবিক স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল । দুদু মিঞার নেতৃত্বে গ্রামে স্থানীয় সরকার গঠন, স্থানীয় সেনাবাহিনী গঠন, স্থানীয় আদালত স্থাপন, জনগণের থেকে কর আদায় প্রভৃত কাজ চলতে থাকে ।

*****

Related Items

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কীরূপ মনোভাব ছিল ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কীরূপ মনোভাব ছিল ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সাধারণভাবে সমর্থন করেননি ।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন ?

প্রশ্ন : ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন ?

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা কর ।

প্রশ্ন : স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা কর ।

নারী ইতিহাসের ওপর একটি টীকা লেখ ।

প্রশ্ন : নারী ইতিহাসের ওপর একটি টীকা লেখ ।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর ।