প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ (Europe After World War I)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 13:59

বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ (Post war Europe) :

দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা চলার পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান  ঘটে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে । এই পরিবর্তনগুলি হল—

(১) বৃহৎ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির পতন এবং নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব :-  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় মানচিত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে । ইউরোপের চারটি বড়ো সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, যেমন— (ক) অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য,  (খ) তুরস্ক সাম্রাজ্য,  (গ) রুশসাম্রাজ্য ও (ঘ) জার্মান সাম্রাজ্য । ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন রাজ্যের সীমানা নির্ধারণের ফলে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া প্রভৃতি নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় ।

(২) জাতীয়তাবাদের সাফল্য :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জয়যুক্ত হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লাভাকিয়া, তুরষ্ক, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে জাতীয়তাবাদ সাফল্য লাভ করে । বল্কান অঞ্চলে নির্যাতিত জাতীয়তাবাদের আংশিক সাফল্য ঘটে ।

(৩) গণতন্ত্রের জয় :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরোপ মহাদেশের জার্মানি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের উত্থান হয় । জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম হল্যান্ডে পালিয়ে যান এবং জার্মানিতে ‘ভাইমার প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয় । তুরস্কের সুলতানকে পদচ্যুত করা হয় এবং কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে গণপ্রজাতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় ।

(৪) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রতিপত্তি হ্রাস : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের পূর্ব প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে ও সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই স্থান দখল করে নেয় ।

(৫) গণতন্ত্রের পতন ও একনায়কতন্ত্রের উত্থান :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হলেও (ক) গণতন্ত্রের মড়ক, (খ) নব প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা, (গ) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব, (ঘ) দূরদর্শী জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতার অভাব, (ঙ) অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত, (চ) জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে ইউরোপের জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি অনেক দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় এবং একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয় ।

(৬) জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে । এই সময়কালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বরাষ্ট্রগুলি যুদ্ধের বিভীষিকা দূর করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ঘোষিত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ -র ওপর ভিত্তি করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে এপ্রিল 'লিগ অফ নেশনস' বা জাতি সংঘের প্রতিষ্ঠা হয় । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ১০ ই জানুয়ারি লিগ অফ নেশনস -এর প্রথম অধিবেশনে উড্রো উইলসন সভাপতিত্ব করেন ।  জাতিসংঘের মুখ্য উদ্দেশ্য হল—

(ক) পারস্পরিক আপস-মিমাংসা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করা ।

(খ) যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা ।

(গ) আর্থসামাজিক কল্যাণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠন এবং নারী, শিশু ও অবহেলিতদের সাহায্য করা । বিশ্বের প্রতিটি দেশ যাতে আন্তর্জাতিক আইন, বিধি নিষেধ ও চুক্তি মেনে চলে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখাই ছিল এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার মুখ্য উদ্দেশ্য ।

জাতিসংঘের সদর কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত । পরিষদের ৬ জন স্থায়ী ও ৯ জন অস্থায়ী মিলিয়ে ১৫ জন সদস্য করা হয় । 

(৭) ইউনিয়ন আন্দোলন :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই শ্রমিকগণ তাঁদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে সজাগ হন । ফলে সে সব দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য তাঁরা ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করেন । অনেক দেশে শ্রমিক কল্যাণসূচি গ্রহণ এবং শ্রমজীবীদের স্বার্থরক্ষার নানা আইন প্রবর্তন করা হয় । রাশিয়ায় বলশেভিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা লাভ করে ।

(৮) অর্থনৈতিক অবস্থা :-  (১) মুদ্রাস্ফীতি,  (২) শিল্পে অচলাবস্থা, (৩) কৃষিজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস,  (৪) অর্থনৈতিক মন্দা, (৫) বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল ।

ইতালি ও জার্মানিতে গণতন্ত্রে পতনের কারণ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাৎক্ষণিক ভাবে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটলেও কিন্তু এই ব্যবস্থাও চিরস্থায়ী হয়নি । কয়েক বছরের মধ্যেই ইউরোপের বহু দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন হয় এবং একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ৩৫টিরও বেশি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ছিল, কিন্তু ১৯৩৮ সালে তা কমে ১৭টি দেশে পৌঁছায় । এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গ্যাথন হার্ডি লিখেছেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বহু দেশে ‘গণতন্ত্রের মড়ক' দেখা দেয় । জার্মানি ও ইতালিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে

(ক) নব প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা, 

(খ) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব,

(গ) দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতার অভাব, 

(ঘ) অর্থনৈতিক মন্দা, 

(ঙ) জাতিসংঘের ব্যর্থতা, 

(চ) আর্থিক সংকট,

(ছ) খাদ্যাভাব, 

(জ) শিল্পে অবনতি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারি প্রভৃত আর্থ-সামাজিক সংকট, 

(ঝ) সাধারণ মানুষের হতাশা, 

(ঞ) রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিরোধ, প্রভৃতি কারণের ফলে জার্মানি ও ইতালিতে গণতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয় ।

ঐতিহাসিক গর্ডন গ্রেসের মতে, ইতালি ও জার্মানিতে গণতন্ত্রের পতন এবং ফ্যাসিস্ট দল ও নাৎসী দলের ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল দুটি প্রধান ঘটনা, যার একটি ছিল অর্থনৈতিক মন্দা এবং অপরটি হল গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব, এর ফলে এই দুটি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট দল ইটালিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে । জার্মানিতে নাৎসি দল দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে এই দুটি দেশে গণতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় ।

******

Related Items

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society)

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society):-

বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা কর

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Participation of Students in the anti-Partition Movement of Bengal):-

বাংলার মানুষদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্র

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Students' Movements in Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দ

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী (Women's Wing of the Ajad Hind Fauj):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাসবিহারী বসু জাপানে গিয়ে সেখানে তিনি বিপ্লবীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় ছিলেন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta)

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করলেও ব