দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার কারণ (Causes of The Second World War) :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (Second World War) : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় । বিশ্বের তাবৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এক এক পক্ষ নিয়ে এই যুদ্ধে যোগদান করে । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ একটানা ছয় বছর ধরে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলিতে এই ভয়ংকর যুদ্ধ চলে । মিত্রশক্তির কাছে জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয় । ইটালি ও জার্মানি আগেই পরাজয় স্বীকার করেছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ (Causes of the Second World War) :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরাট ধ্বংসকার্য শেষ হওয়ার মাত্র একুশ বছরের মধ্যেই বিশ্ববাসী আরও একটি বিধ্বংসী যুদ্ধের মুখোমুখি হয় । বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যাকালে ঐতিহাসিকরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন, যেমন—
(১) ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা ও জার্মানির প্রতিশোধ স্পৃহা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত জার্মানির ওপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয় । সন্ধির শর্ত সম্পর্কে জার্মান প্রতিনিধিদের মতামত উপেক্ষা করে তাঁদের সন্ধিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল । সেই একতরফা চুক্তিকে জার্মানির জনগণ কোনো দিনই মেনে নেয় নি । ইতিমধ্যে জার্মানি ভিতরে ভিতরে সামরিক শক্তিকে সুসজ্জিত করে তোলে । জার্মানির জনগণের সেই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে তাই মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি ভার্সাই সন্ধির সমস্ত অপমানজনক চুক্তি ভেঙে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । বলা যেতে পারে ভার্সাই সন্ধির কঠোরতার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল ।
(২) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি :- হিটলারের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের আপসমূলক তোষণ নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল । জার্মানির বেপরোয়া অস্ত্রসজ্জা, রাইনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কোনো রকম বাধা না দেওয়ায় জার্মানি আরও বেপরোয়া ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে । এই কারণেই ঐতিহাসিক এ. জে. পি. টেলর হিটলারের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের আপসমূলক তোষণ নীতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ বলে অভিহিত করেছেন ।
(৩) বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপস্থিতি :- মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চেষ্টাতে জাতিসংঘ স্থাপিত হলেও মার্কিন সেনেট তা অনুমোদন করে নি । ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল দেশ জাতিসংঘের বাইরে ছিল । ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাতে জাতিসংঘের দায়িত্ব থাকলেও আমেরিকার অনুপস্থিতিতে তারা বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমনে ব্যর্থ হয় ।
(৪) জার্মানি, ইতালি ও জাপানের উপনিবেশ বিস্তারের আকাঙ্খা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । জার্মানি, ইতালি ও জাপানের ভাগ্যে কোনো উপনিবেশই জোটেনি । জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যে এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করে । এই ভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনে ।
(৫) গণতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলির মতবিরোধের সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিস্তার :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দেয় । দুই বৃহৎ গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের এই মতবিরোধ ফ্যাসিবাদী শক্তির বিস্তারকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল ।
(৬) জাতি সংঘের ব্যর্থতা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য লিগ অফ নেশনস বা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয় । কিন্তু জাতিসংঘের ব্যর্থতার জন্যই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববাসী আরও একটি ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয় । জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ গুলি ছিল—
(ক) সাংগাঠনিক ত্রুটি,
(খ) নিজস্ব সেনাবাহিনীর অভাব,
(গ) বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপস্থিতি,
(ঘ) নিরস্ত্রীকরণে ব্যর্থতা,
(ঙ) সদস্য রাষ্ট্রের ভিটো প্রয়োগ প্রভৃতি । এইভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল দায়িত্ব পালনে লিগ অফ নেশনস ব্যর্থ হয়, যার পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসম্ভাবী হয়ে ওঠে ।
*****
- 36900 views