ঠান্ডা লড়াই এর সূচনা

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 04/26/2012 - 18:17

ঠান্ডা লড়াই এর সূচনা (Cold war and its origin)

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে উদ্ভুত প্রতিযোগিতা থেকে সশস্ত্র সংঘর্ষের পরিবর্তে দুটি বিবদমান রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মধ্যে যে কূটনৈতিক তৎপরতা, মানসিক টানাপোড়েন ও স্নায়ুর লড়াই চলে তাকে ঠান্ডা যুদ্ধ বলে । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত মার্কিন ভাষ্যকার ও চিন্তাবিদ ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর লেখা বই 'The Cold War' -এ প্রথম 'Cold War' শব্দটি ব্যবহার করেন । দুই মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট রাশিয়া মধ্যে এই ঠান্ডা লড়াই শুরু হয় । প্রাক্তন সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী ম্যাক্সিম লিটভিনভ -এর মতে ঠান্ডা লড়াই এর অন্তর্নিহিত কারণ হল আদর্শবাদী মতাদর্শের মহাসংঘাত ।

ঠান্ডা যুদ্ধের কারণ (Cold war and its cause) :

(১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বি-মেরুকরণ শুরু হলে, তার ফলশ্রুতিতে আদর্শগত সংঘাতের সূত্রপাত হয় । দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদ ও জীবনাদর্শ একে অপরের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়, যার অনিবার্য পরিণাম হল এক ধরনের অস্ত্রবিহীন মানসিক তথা স্নায়ুর লড়াই, পারস্পরিক চাপ সৃষ্টির কৌশল । এ থেকেই ঠান্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত ।

(২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে সরে গিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার অনুকূলে চলে যায় । দুটি বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের আবির্ভাবে দুটি নতুন শক্তিজোট তৈরি হয়, যার এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দিকে সোভিয়েত রাশিয়া অবস্থান করে । ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির কিছু কিছু দেশ আমেরিকা ও কিছু কিছু দেশ রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলে পৃথিবী দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায় । একটি আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশ, অন্যটি রাশিয়া ও তার মিত্র দেশ । এর মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকার কিছু দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয় এবং জোটনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে । ভারতবর্ষ তার অন্যতম ।

(৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বৃহৎ শক্তিধর দেশ দুটি অপর দেশগুলির ওপর তাদের প্রভাব বিস্তারে উদ্যোগী হয় । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের ওপর তার সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়, অন্যদিকে রাশিয়া তার সমাজতান্ত্রিক ভাবনা দেশে দেশে ছড়িয়ে দিতে চায় । এভাবেই দুই দেশ আবার এক ধরনের কূটনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় । শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ । সাম্রাজ্যবাদী ভাবনার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার লড়াই এই যুদ্ধের মূলকথা ।

(৪) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার ফুলটন শহরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এইচ. ট্রুম্যানের সামনে এক ভাষণে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিরামহীন রাজনৈতিক সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করেন । চার্চিল তার ভাষণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত শক্ত করার জন্য অস্ত্রসজ্জা, সমাজতান্ত্রিক আগ্রাসন ঠেকাতে রাশিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, সামরিক জোট গঠন ইত্যাদি পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন । এরই পরিণতিতে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমি প্রাধান্য বজায় রাখতে শক্তির আস্ফালনের জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিজোট, যেমন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল ন্যাটো (NATO) (North Atlantic Treaty Organisation), ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সিয়াটো (SEATO) (South-East-Asia Treaty Organisation ), ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সেন্টো (CENTO) ইত্যাদি সামরিক শক্তিজোট গঠন করে । অন্যদিকে রাশিয়ার নেতৃত্বে এশিয়া, আফ্রিকা এমনকি ইউরোপের কিছু কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা জনপ্রিয়তা লাভ করে । পূর্ব জার্মানি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি দেশে সাম্যবাদী আন্দোলন জয়যুক্ত হয় ও গণতান্ত্রিক সরকারের জায়গায় সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয় । ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট ধীরে ধীরে শক্তিসঞ্চয় করতে থাকে । একই সঙ্গে কিছু কিছু দেশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে ।

(৫) এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিস্তার, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রসার ইত্যাদির প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে । বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলি সমাজতন্ত্রীদের প্রভাবমুক্ত হয়ে যাতে তাদের দিকে যোগ দেয় তার জন্য তারা কতকগুলি অর্থনৈতিক কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন । আমেরিকা দুটি অর্থনৈতিক কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে । একটি ট্রুম্যান নীতি (Truman Doctrine, April 1947) এবং অপরটি মার্শাল পরিকল্পনা (Marshall Plan) । দুটি পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে রাশিয়া ও তার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কবল থেকে মুক্ত করে আনা । দুই রাষ্ট্রের এই লড়াই ও মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল । একদিকে আমেরিকার উদ্দেশ্য সমাজতান্ত্রিক ভাবনার কন্ঠরোধ করে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করে রাশিয়ায় দিকে দিকে সমাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রয়াস । বিশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত দুই শক্তিশালী গোষ্ঠীর মধ্যে এই ঠান্ডা লড়াই চলেছিল । এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার ভাঙ্গনের পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যেকার শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সেই সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয় ।

*****

Related Items

ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রকাশ করা হয় । ভারতীয় সংবিধানের চারটি উল্লেখযোগ্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—

মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

প্রশ্ন:-  মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:- ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

প্রশ্ন:-  ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?