জাতীয় চেতনার উন্মেষ

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 07:35

জাতীয় চেতনার উন্মেষ (Emergence of Indian Nationalism) :

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তারই অব্শ্যম্ভাবী পরিণতি হল এদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষ । উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ় হয়, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের ফলে জাতীয় আন্দোলন ক্রমে সাংগঠনিক রূপ লাভ করতে থাকে । ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের মূল কারণ ভারতীয় ও ব্রিটিশ স্বার্থের সংঘাত । ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যে শোষণ শুরু করেছিল তার ফলে সর্বস্থরের মানুষের মনের মধ্যেই অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল । এই অসন্তোষের কারণ ছিল বহুবিধ । বলা যেতে পারে এই সার্বিক অসন্তোষ থেকেই ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল । সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি কারণই ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকাশের পটভূমি তৈরী করতে সাহায্য করেছিল । কার্ল মার্কস এই ধরণের রাজনৈতিক সচেতনতাকে ইতিহাসের অজ্ঞান ও অচেতন হাতিয়ার বলে অভিহিত করেছিলেন ।

জাতীয়তাবোধের উন্মেষে সংস্কার আন্দোলনের ভুমিকা (Role of various Reforms Movement on Emergence of Indian Nationalism) :

উনবিংশ শতাব্দীর ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পিছনে বিবিধ প্রেরণা কাজ করেছিল । সেগুলির মধ্যে প্রধান হল যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ । এই আন্দোলনগুলি ধর্মীয় ভাবনা ছাড়াও ভারতীয় সমাজে অধিকতর আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও স্বদেশের জন্য গৌরববোধ সঞ্চারের চেষ্টা করেছিল । ফলে মানুষের মনে জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় । মানুষ ব্রিটিশ শাসন ও শোষণকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে । সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়ছিল । ঐতিহাসিক এ.আর. দেশাই মনে করেন ভারতে প্রথম জাতীয় জাগরণ ঘটে সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকেই ।

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব (Role of Western Education on Emergence of Indian Nationalism) :

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় তরুণরা নতুন জ্ঞানের অন্বেষণে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন । এর অন্যতম ফল হল ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশ । পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয় । ইউরোপের জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক আদর্শ তাঁদের মনে গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করে । ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন, আফ্রিকার বুয়োর যুদ্ধ, রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন, রুশ-জাপান যুদ্ধ, আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি ঘটনাবলী ভারতীয়দের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল । এই সমস্ত আন্দোলনের নায়করা শিক্ষিত ভারতীয়দের আদর্শে পরিণত হয় । ইংরেজি ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয়দের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানের বাহন হয়ে ওঠে ও ভারতে ঐক্যবোধ জাগরিত হয় । তবে শুধুমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই যে জাতীয় চেতনার বীজ নিহিত ছিল একথা সম্পূর্ণ ভাবে মনে করা ঠিক নয় । কারণ সরকারি স্কুল কলেজে যে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হত তার উদ্দেশ্য ছিল রাজভক্ত তৈরি করা । কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের স্বরূপ উপলবদ্ধি করতে পেরেছিল বলেই জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ।

সংবাদপত্র ও সাহিত্যের ভুমিকা (Role of Press and Patriotism in Literature on Emergence of Indian Nationalism) :

জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল তৎকালীন সংবাদপত্র ও দেশাত্মবোধক সাহিত্য সমূহ । যেসব জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকা ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠন ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করেছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— সোমপ্রকাশ, বঙ্গদর্শন, সংবাদ প্রভাকর, সমাচার দর্পণ, সুলভ সমাচার, তত্ত্ববোধিনী, বোম্বে সমাচার, ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া বর্তমানে দি স্টেটসম্যান, ভয়েজ অফ ইন্ডিয়া, নেটিভ ওপিনিয়ন, মারাঠি, কেশরী, আজাদী, আহমদী, ইন্দুপ্রকাশ, স্বদেশমিত্রম, জাম-ই-জামশেদ, সুধাকর, অমৃতবাজার পত্রিকা, বেঙ্গলি, ইন্ডিয়ান মিরর, হিন্দু প্যাট্রিয়ট ইত্যাদি ।

দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধায়ের 'বৃত্রসংহার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দ মঠ', রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধায়ের 'পদ্মিনী উপাখ্যান',  রমেশচন্দ্র দত্তের 'রাজপুত জীবন সন্ধ্যা', ও 'মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত' প্রভৃতি সাহিত্য ঊনিশ শতকের জাতীয়তাবোধের উন্মেষে সাহায্য করেছিল । এ ছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'মেবার পতন', 'সূর্যের দেশ', 'শাহজাহান',  মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্য', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চার অধ্যায়', 'ঘরে বাইরে', 'মুক্তধারা', 'রক্তকরবী', নবীনচন্দ্র সেনের 'পলাশীর যুদ্ধ', শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পথেরদাবী' অগণিত মানুষকে স্বাধীনতা প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল । মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদ বধ কাব্যে' দেশভক্ত ইন্দ্রজিৎ -এর উক্তি 

         "জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে 

              যে ডরে ভীরু, সে মূঢ়, শত ধিক তারে"

   - মনে হয় এ যেন কোনো স্বাধীনতা প্রেমীরই উক্তি । এভাবে বলা যায় যে, পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণে স্বাধিকারের যে চেতনা মুষ্টিমেয় শিক্ষিতের মধ্যে ছাড়িয়ে পড়েছিল, সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তা বহুর মধ্যে সঞ্চারিত হয় । এছাড়া দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত ও দেশীয় নিয়ন্ত্রণে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠন ও স্বতঃস্ফুর্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য অবদান জুগিয়েছিল ।

*****

 

 

Related Items

চম্পারণ সত্যাগ্রহ (Champaran Satyagraha)

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সদ্যসমাপ্ত সফল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে ফেরেন । তিনি প্রথমেই ব্রিটিশ সরকারকে ভাড়াটে শ্রমিক আইন রদ করতে অনুরোধ করেন । এই আইন বলে ভারত থেকে ঠিকা শ্রমিকদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হত ...

মহাত্মাগান্ধী ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রূপান্তর

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি এক অবিস্মরনীয় নাম । তাঁর জীবনাদর্শ, নীতি ও কর্মপদ্ধতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায় । অহিংস সত্যাগ্রহ, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক ...

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ (Europe After World War I)

দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা চলার পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে । এই পরিবর্তনগুলি হল --

শক্তিজোট গঠন (Alliances)

একটি জার্মানি, ইটালি ও অস্ট্রিয়াকে নিয়ে ত্রিশক্তি চুক্তি (Triple Alliance), এবং অন্যটি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে ত্রিশক্তি মৈত্রী (Triple Entente) । এই দুই শক্তি গোষ্ঠির সংঘাতে বিশ্ব পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের মাটিতে হলেও ভারতে তার প্রভাব পড়েছিল ...

সাম্রাজ্যবাদ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি

সাম্রাজ্যবাদ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান । সাম্রাজ্যবাদ বলতে সাধারণত সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকেই বোঝানো হয় । বিসমার্কের পর জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম, কান্ট, ফিকটে, হেগেল নিটসে, বার্নহার্ড, ট্রিটসকে প্রমুখ জার্মান দার্শনিক জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ..