ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 01/27/2022 - 12:19

প্রশ্ন : ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।

উঃ- উনবিংশ শতকে বাংলাতে ছাপাখানা শিক্ষাবিস্তারের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল । চলমান হরফের প্রচলন ও মুদ্রণ বিপ্লব সারা বিশ্বের জ্ঞানচর্চাকে উচ্চশ্রেণীর সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসারিত করেছিল । ভারত তথা বাংলায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ সর্বোপরি গণশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানা ও ছাপাবই -এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । রেভারেন্ড জেমস লঙ -এর মতে, মুদ্রণ ও শিক্ষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত । শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে মুদ্রিত পুস্তকের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে । ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে শিক্ষাদান উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর প্রচুর ছাপা বই বাজারে আসে । ছাপা বইপত্র দামে সস্তা হওয়ায় সেগুলি সাধারণ মানুষের হাতে সহজে পৌঁছে যায় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়, ফলে দেশে ব্যাপক শিক্ষা বিস্তার শুরু হয় ।

পর্তুগিজরা প্রথম ১৫৫৬ সালে এদেশে আধুনিক ছাপা-যন্ত্র নিয়ে আসে । এর পরে জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় এবং চার্লস উইলকিন্স চুঁচূড়াতে একটি ছাপাখানা তৈরি করে । এর প্রভাবে ছাপার বইয়ের সংখ্যা বাড়ে । উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা স্থাপন করলে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে । ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বইগুলি জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, যেমন— শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানার উদ্যোগে বাংলায় প্রচুর স্কুলপাঠ্য বই কম দামে পৌঁছায় । কম খরচে বা বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গড়ে ওঠে বহু বিদ্যালয় । সচিত্র পুস্তক মানচিত্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভে আগ্রহী করে তোলে । ছাপাখানা শিশুশিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসার ঘটায়, প্রকাশিত হয় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের 'শিশুশিক্ষা', বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়', রামসুন্দর বসাকের 'বাল্যশিক্ষা' গোবিন্দপ্রসাদ দাসের 'ব্যাকরণ সার' । শ্রীরামপুরের ছাপাখানা ছাড়াও হিন্দুস্থানি প্রেস,পার্সিয়ান প্রেস ও সংস্কৃত প্রেস থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বইপত্র ছাপা হত । বাংলার ছাপাখানায় প্রকাশিত হয় পঞ্জিকা, আইন, ধর্ম, নীতিকথা, ইতিহাস, কৃষিকাজ, সংগীত, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ের বই যার ফলে উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে যেতে থাকে শিক্ষার্থীদের সামনে, তারা উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ লাভ করে এবং ছাপা হয় আঞ্চলিক ও অনুবাদ সাহিত্য । বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা মুদ্রণশিল্পের ব্যবসায়িক বাজার গড়ে তোলে এবং ছাপাখানার কাজে বই ছাপার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে ছবি, মানচিত্র, নকশা ইত্যাদিতে গুরুত্ব পায় ও পেশাদারিত্বের সূচনা ঘটায় যা বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় ।

*****

Comments

Related Items

মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন (Montague-Chelmsford Reforms)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) অবসানে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের কিছু শাসনতান্ত্রিক সুযোগ সুবিধা দান করে ভারতবাসীকে তুষ্ট রাখার জন্য সচেষ্ট হন । এই উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করেন ...

হোমরুল আন্দোলন (Home Rule Movement)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হোমরুল আন্দোলন ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্দীপ্ত করেছিল । শ্রীমতী অ্যানি ব্যাসান্ত আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতা রেমন্ড -এর হোমরুল লিগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে এই আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন । জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একটি দায়িত্বশীল ...

লখনউ চুক্তি (Lucknow Pact)

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লখনউ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রথম অধিবেশন বসে । এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে একটি সমঝোতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন ...

খেদা-কয়রা আন্দোলন (Kheda-Khaira Movement)

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের কয়রা বা খেদা জেলায় খরা হওয়ার দারুন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । গান্ধিজি খরা পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের জমির খাজনা বন্ধ রাখতে বলেন । তাঁর এই করদান বন্ধ আন্দোলনে তাঁর প্রধান সহায় ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ...

চম্পারণ সত্যাগ্রহ (Champaran Satyagraha)

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সদ্যসমাপ্ত সফল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে ফেরেন । তিনি প্রথমেই ব্রিটিশ সরকারকে ভাড়াটে শ্রমিক আইন রদ করতে অনুরোধ করেন । এই আইন বলে ভারত থেকে ঠিকা শ্রমিকদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হত ...