Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 04/26/2012 - 12:52

গণপরিষদ গঠন (Constituent Assembly)

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে । শাসনতন্ত্র অনুসারে দেশ পরিচালিত হয় আর এই শাসনতন্ত্রই হল সংবিধান । ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য দুটি পৃথক গণপরিষদ গঠনের কথা বলেন । ভারতের সংবিধান রচনার জন্য বিভিন্ন প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয় । ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই ক্যাবিনেট কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এই গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল । ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন এই গণপরিষদের সভাপতি । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর থেকে ২৩শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সভাপতিত্বে এই গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে । ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এই গণপরিষদের কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল না । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' বিধিবদ্ধ হলে ভারতীয় গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং সংবিধান রচনার কাজ শুরু করে । ভারতীয় গণপরিষদে প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলির মোট ৩০৭ জন জনপ্রতিনিধি ছিলেন । এই গণপরিষদ ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন ধরে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করে । এই সময় গণপরিষদের মোট ১১টি অধিবেশন বসেছিল । ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর -এর নেতৃত্বে সংবিধানের একটি খসড়া কমিটি (Draft Committee) গঠিত হয় । সংবিধান সভা যে সংবিধান রচনা করেছিল, তা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর ভারতীয় গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং গণপরিষদের সভাপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এতে স্বাক্ষর করেন । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের 'ভারত শাসন আইন' অনুসারে এই সংবিধান রচিত হয়েছিল । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি থেকে এই নতুন সংবিধান অনুসারে ভারত শাসন শুরু হয় । ভারতের সংবিধান রচনাকালে যেসব প্রখ্যাত মনীষীদের ভূমিকা ছিল তাঁদের মধ্যে ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, আবুল কালাম আজাদ, আচার্য জে. বি. কৃপালনী, কে. এম. মুন্সী, টি. টি. কৃষ্ণমাচারী, গোপালস্বামী আয়ার, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়ার, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।

গণপরিষদের সদস্যদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয় । সংবিধানের নানা খুঁটিনাটি দিক বিচার করে গণপরিষদ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করে । তারপর খসড়া কমিটির হাতে সংবিধানের চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় । ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ছিলেন ভারতের খসড়া সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান । বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রদত্ত রিপোর্ট এবং তথ্য বিচার-বিবেচনা করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংবিধানটি গণপরিষদে পেশ করা হয় । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর সেটি গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং স্থির হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকর হবে । কুড়ি বছর আগে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতবাসী প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছিল । সেই শুভ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই ২৬শে জানুয়ারি দিনটি বেছে নেওয়া হয় । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি থেকে ভারতের নতুন সংবিধান বলবৎ হয় । ওই দিন থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে আত্ম প্রকাশ করে । সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতবর্ষকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করা ছাড়াও আরও কতকগুলি উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে । সেগুলি হল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, চিন্তা, মতামত প্রকাশ, ধর্মবিশ্বাস এবং পূজাঅর্চনার স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা এবং ব্যক্তিগত মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি করা ।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূল বয়ানটি এরূপ :

-: প্রস্তাবনা :-

”আমরা ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিকদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার সমতা সৃষ্টি; এবং তাদের সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব গড়ে তুলে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের গণপরিষদে আজ ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি ।“

ভারতীয় জনগণই এই সংবিধানের প্রণেতা, জনগণই নিজেরা নিজেদের হাতে এই সংবিধান তুলে দিয়েছেন অর্থাৎ নব রচিত শাসনব্যবস্থায় জনগণই হচ্ছেন সকল ক্ষমতার উৎস । দেশের শাসনভার পরোক্ষভাবে দেশের জনগণেরই ওপর ন্যস্ত । জনগণ রচিত শাসনবিধি অনুযায়ী এই দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয় বলে এই শাসনবিধিকে সাধারণতন্ত্র বলা হয় । আবার জনগণ অর্থে প্রজা । প্রজাদের রচিত শাসনতন্ত্র অনুসারে দেশ শাসিত হয় বলে একে প্রজাতন্ত্র নামেও অভিহিত করা হয় । ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে দেশের শাসনতন্ত্র চালু বলে '২৬ শে জানুয়ারি' দিনটি সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র দিবসরূপে চিহ্নিত হয়ে আসছে । প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষের সাংবিধানিক প্রধান একজন রাষ্ট্রপতি এবং শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সহযোগী অপরাপর মন্ত্রী থাকলেও ওই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যমণি হলেন এর প্রজাবৃন্দ অর্থাৎ জনগণ

***** 

 

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা