Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 17:21

খিলাফৎ আন্দোলন (Khilafat Movement) :

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করেছিল । এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির পরাজয়ে খলিফারও পরাজয় ঘটে । যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে 'ভার্সাই শান্তি সমাবেশে' বিভিন্ন পরাজিত দেশের সঙ্গে মোট পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল । মিত্রপক্ষ তুরস্কের ওপর নানা অপমানজনক সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দেয় এবং তুরস্কের সুলতান অপমানিত ও সিংহাসনচ্যুত হন । তুরস্কের সুলতান ছিলেন তুরস্কের শাসক এবং বিশ্বের মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের নেতা বা খলিফা । খলিফার সিংহাসনচ্যুতি এবং অপমানে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে । ভারতীয় মুসলিম সমাজ আশা করেছিলেন, মিত্রপক্ষের অন্যতম শক্তি ব্রিটিশ অন্তত তুরস্কের প্রতি সুবিচার করে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষা করবেন । তুরস্কের সুলতান তথা খলিফাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা বিশ্বজোড়া আন্দোলন গড়ে তোলেন । ইতিহাসে এই আন্দোলন খিলাফৎ আন্দোলন নামে পরিচিত । ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় খিলাফৎ প্রশ্নকে সমর্থন করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেন । খিলাফৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসাবে আলি ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মৌলানা মহম্মদ আলিসওকৎ আলির উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ই অক্টোবর 'খিলাফৎ দিবস' পালিত হয় । এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মৌলানা মহম্মদ আলি ও সওকৎ আলি । তুরস্কের মতো ভারতের খিলাফৎ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল খলিফা সম্পর্কে ব্রিটিশকে তাঁদের নীতি পরিবর্তন করতে এবং খলিফাকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বাধ্য করা । ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন পরিচালিত করার জন্য মৌলানা মহম্মদ আলি ও সওকৎ আলি  ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে 'নিখিল ভারত  খিলাফৎ কমিটি' গঠন করেন । এই কমিটির প্রধান প্রধান দাবি ছিল—

(ক) তুরস্কের সুলতানকে মুসলিম দুনিয়ার ‘খলিফা’ পদে পুনর্বহাল করা ।

(খ) আরবের পবিত্র ধর্মস্থানগুলির ওপর খলিফার আধিপত্য স্বীকার করা এবং 

(গ) বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখা ।

এইসব দাবিগুলি সামনে রেখে 'নিখিল ভারত খিলাফৎ কমিটি' ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন করতে গিয়ে যেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান হল— 

(ক) সরকারি বেসামরিক পদে ইস্তফা দান করা ।

(খ) সরকার প্রদত্ত উপাধি বর্জন ও অবৈতনিক কাজ বন্ধ করা ।

(গ) সরকারি খাজনা ও কর প্রদান বন্ধ করা ।

(ঘ) পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পদ থেকে ভারতীয়দের ইস্তফা দান করা ।

(ঙ) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা ।

(চ) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপন ।

এই কমিটির সদস্যগণ খিলাফৎ প্রশ্নের সম্মান জনক মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন ।  বালগঙ্গাধর তিলক ও গান্ধিজি উভয়েই খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন । গান্ধিজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মুসলিমদের ন্যায় সংগত দাবি মেনে নিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন । অন্যথায় তিনি সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার কথা ব্যক্ত করেন । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে গান্ধিজির সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ যৌথভাবে খিলাফৎ আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন । সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব একই সঙ্গে নিখিল ভারত খিলাফৎ কমিটি এবং জাতীয় কংগ্রেসে অনুমোদিত হয় । এভাবে খিলাফৎ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের সূচনা হয় । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে খিলাফৎ আন্দোলনকে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয় । ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আতাতুর্ক কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলে খিলাফৎ আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায় ।

*****

Related Items

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Kashmir):-

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দু

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Hyderabad):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে ।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪)

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) [Post-Colonial India : Second Half od the 20th Century (1947-1964)]:-

দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মবলিদানের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন

হিন্দু জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার উল্লেখযোগ্য দলিত হিন্দু সম্প্রদায় । নমঃশূদ্ররা হিন্দু জাতিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত । নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । ...