Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 19:00

কোল বিদ্রোহ (Kol movements)

কোল বিদ্রোহ (Kol movements) : উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে, তাদের মধ্যে কোল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম । বিহারের ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালে কোল উপজাতি গোষ্ঠী বসবাস করত । কোল উপজাতি গোষ্ঠী জঙ্গলের কৃষিজ সম্পদ অবাধে ভোগ করত এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করত । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুর এলাকার শাসনভার গ্রহণ করে ঐ এলাকায় কোম্পানি নতুন ভূমিবন্দোবস্ত চালু করে । কোম্পানি কোলদের বসবাস অঞ্চলটি বহিরাগত (দিকু) হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মহাজনদের এখানকার জমির ইজারা দিয়ে তাদের হাতে রাজস্ব আদায়ের অধিকার তুলে দেয় । এই বহিরাগত মহাজনরা উচ্চ হারে রাজস্ব ও একাধিক কর আদায় করতে শুরু করে । কর দিতে ব্যর্থ কোলদের জমি থেকে উৎখাত করা হয় ও অনেককে বলপূর্বক আফিম চাষে বাধ্য করা হয় । ফসলের পরিবর্তে তাদের থেকে নগদ অর্থে খাজনা নেওয়া শুরু হয় । রাস্তা তৈরির জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কোলদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হয় । এভাবে কোলদের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটানো হলে তারা বিদ্রোহের পথে যায় । ১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে পোড়াহাটের জমিদার ও তার ইংরেজ সেনাপতি রোগসেস -এর বিরুদ্ধে 'চাইবাসার যুদ্ধে' কোলরা পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে । তির-ধনুক, বর্শা, বল্লম নিয়ে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রধারী ইংরেজদের সঙ্গে পেরে ওঠা কোলদের পক্ষে সম্ভব ছিল না । কিছুদিন পর ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধ ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি ও সুই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে আবার কোল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়ে ওঠে । ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহের আগুন সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ ইত্যাদি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । বিদ্রোহীরা জমিদার, জোতদার, ব্যবসায়ী, মহাজন, ব্রিটিশ কর্মচারী সকলের ওপরেই আক্রমণ চালায় । তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়, এবং বহু লোককে হত্যা করে । বিদ্রোহীরা থানাগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয় । শেষপর্যন্ত ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে বিশাল ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে বহু কোল উপজাতীয় নরনারীকে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করে ।

কোল বিদ্রোহের ফলে কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের নীতির কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটায় । ছোটোনাগপুরের বিভাগটিকে বিহার প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক সামরিক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষের ওপর এই প্রদেশটির পরিচালনার ভার দেওয়া হয় । ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কোলদের জন্য 'দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি' নামে এই ভূখন্ডটি নির্দিষ্ট করে এবং ঘোষণা করে যে, এই এলাকায় ব্রিটিশ আইন কার্যকরী হবে না । এখানে আদিবাসীদের নিজস্ব নিয়ম চালু থাকবে । ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার অসৎ ব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কোল অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে । এই ব্যবস্থা ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলবৎ থাকে । এসব সত্ত্বেও খাজনার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শোষণের মাত্রাও হ্রাস পায়নি ।

বৈশিষ্ট্য : কোল বিদ্রোহের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল —

(১) কোল বিদ্রোহে হো, মুন্ডা, ওরাঁও প্রভৃতি উপজাতি সম্প্রদায় অংশ নেয় ।

(২) কোল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে কোলদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ।

(৩) কোল উপজাতি গোষ্ঠীর এই বিদ্রোহের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ছিল জমিদার, স্থানীয় মহাজন, বহিরাগত মহাজন (দিকু) বিরোধী ।

(৪) এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ উপজাতি সংগ্রামের রূপ নেয় । তাই দেখা যায়, বিদ্রোহের চূড়ান্ত পর্বে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের খন্ডযুদ্ধ বাধে ।

(৫) চার্লস মেটকাফের মতে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো । ঐতিহাসিক জগদীশচন্দ্র ঝা বলেছেন সুযোগ্য নেতার অভাব, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত মানুষের সমর্থনের অভাব ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগের অভাবে কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় ।   

*****

Related Items

ভারতের রাষ্ট্রপতি (President of India)

গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতবর্ষের মিল থাকলেও ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির পদটি বংশানুক্রমিক নয় । এ ক্ষেত্রে প্রজাতান্ত্রিক দেশ চিন বা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অনেকাংশে মিল আছে । ওই সব দেশের মতো ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপ্রধানও প্রজাপুঞ্জের মধ্যে থেকে ...

ভারতীয় সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য (Salient features of Constitution of Independent India)

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান বলবৎ হওয়ার দিন থেকে এই সংবিধান অনুযায়ী ভারত রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে । পৃথিবীর অগ্রণী দেশসমূহের সংবিধানের ভালো দিকগুলি নিতে গিয়ে ভারতের সংবিধান নানা বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত হয়েছে । ...

গণ পরিষদ গঠন (Constituent Assembly)

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে । শাসনতন্ত্র অনুসারে দেশ পরিচালিত হয় আর এই শাসনতন্ত্রই হল সংবিধান । ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য দুটি পৃথক গণপরিষদ ...

ভারতের স্বাধীনতা আইন ও ক্ষমতা হস্তান্তর (Indian Independence Act, 1947)

লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় পাঠান । ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি সেটি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করেন । পরের দিন ৪ঠা জুলাই ভারতের স্বাধীনতা বিলটি ...

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (The Mountbatten Plan)

দেশব্যাপী চরম উত্তেজনার মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন । এ বিষয়ে প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । ...