Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 07:43

অর্থনৈতিক শোষণ (Economical Exploitation by British Ruler) :

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় তরুণরা নতুন জ্ঞানের অন্বেষণে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন । এর অন্যতম ফল হল ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশ । পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয় । ইউরোপের জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক আদর্শ তাঁদের মনে গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করে । ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন, আফ্রিকার বুয়োর যুদ্ধ, রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন, রুশ-জাপান যুদ্ধ, আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি ঘটনাবলী ভারতীয়দের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল । এই সমস্ত আন্দোলনের নায়করা শিক্ষিত ভারতীয়দের আদর্শে পরিণত হয় । ইংরেজি ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয়দের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানের বাহন হয়ে ওঠে ও ভারতে ঐক্যবোধ জাগরিত হয় ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করা । ইংল্যান্ডের স্বেচ্ছাচারী অর্থনৈতিক শোষণ ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহের উত্স ও ভোগ্যপণ্যের খোলা বাজারে পরিণত করেছিল । অর্থনীতিবিদ অ্যাডামস স্মিথ তাঁর Wealth of Nation গ্রন্থে ইংরেজদের সম্পদ নির্গমনের তত্ত্বটি বর্ণনা করেছেন । অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দাদাভাই নৌরজি, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন । দাদাভাই নৌরজি তাঁর Poverty and Un-British Rule in India গ্রন্থে ভারতীয় সম্পদ নির্গমনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন । ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে কার্ল মার্কস মন্তব্য করেছিলেন যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংসাত্মক রূপ প্রকট হয়ে উঠেছিল । ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি রেল ও আবাদি শিল্পে বিনিয়োগ করা শুরু হলে ভারতীয় শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে । ব্রিটেনে তৈরি দ্রব্য সামগ্রীতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায় । ভারতীয় শিল্পের অগ্রগতিতে নানা বাধার সৃষ্টি করা হয় । ভারতের কুটির শিল্পের অবলুপ্তি ঘটে । অগণিত মানুষ বেকারে পরিণত হয় । ভারতের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙ্গে পড়ে । লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে জীবনের অর্থ হয় অনাহার, অর্ধাহার, দুর্ভিক্ষ ও ব্যাধি । এ প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, "আমরা নিজ নিজ মাতৃভূমিতে ক্রীতদাস ও খেতমজুর ভিন্ন আর কিছুই নই ।" এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ট প্রবক্তা হবসনও স্বীকার করেছেন, যে ব্রিটিশ শাসনে ভারতে প্রকৃত উন্নতি ঘটেনি । দুর্ভিক্ষ ও অনাহার ছিল ভারতবাসীর নিত্য সহযোগী, অথচ ভারতের সম্পদে বৃটেনের ক্রমাগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে । মানুষ ব্রিটিশ শাসন ও শোষণকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে ও ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকাশের পটভূমি তৈরি হয় । 

*****

Related Items

কোল বিদ্রোহ (১৮৩১ -৩২ খ্রিস্টাব্দ)

কোল বিদ্রোহ (Kol Rebellion) : উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে, তাদের মধ্যে কোল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম । বিহারের ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালে কোল উপজাতি গোষ্ঠী বসবাস করত । কোল উপজাতি গোষ্

চুয়াড় বিদ্রোহ (দ্বিতীয় পর্ব, মেদিনীপুর, ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ)

চুয়াড় বিদ্রোহ (Chuar Rebellion) :- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যেসব আদিবাসী কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল চুয়াড় বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহ দুটি পর্বে সংঘটিত হয় । প্রথম পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে । বাংলার মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলম

রংপুর বিদ্রোহ (Rangpur Revolt)

রংপুর বিদ্রোহ (Rangpur Revolt) : ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ত্রুটি, সুদখোর মহাজনদের নির্লজ্জ শোষণ, ঔপনিবেশিক শোষণ এবং কৃষক ও উপজাতিদের ওপর দমন নীতি ইত্যাদির কারণে ও এর প্রতিবাদে বিভিন্ন সময়ে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, কারিগর, জেলে, মুচি, মেথর, ব্যবসায়ী, শিল্পী, ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারণাগত আলোচনা

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারণাগত আলোচনা (Concept of Rebellion, Uprising and Revolution) :বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব —এই তিনের-ই আলাদা আলাদা অর্থ ও উদ্দেশ্য আছে । মানুষ যখন কোনো কিছু পাওয়ার চেষ্টা করে অথবা তাদের স্বার্থ বিরোধী কোনো ব্যবস্থা পছন্

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া (Colonial Forest Law and the reaction of tribal communities) : ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা ন