সুলতানি ও মুঘল আমলের চিত্রকলা

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 10/04/2014 - 13:05

সুলতানি আমলের চিত্রকলা (Art during the Sultanate Period) :

একটি সময় ছিল যখন মনে করা হত সুলতানি আমলে চিত্রকলার কোনো চর্চা হত না । ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল । বর্তমানে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে । আসলে ভারতে ইসলামের আর্বিভাবের ফলে যে সমন্বয়ী প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছিল, তা ভারতের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । এই সময়ের কয়েকজন সুলতান ও হিন্দু প্রধান শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় শিল্পরীতির উদ্ভব হয়েছিল । তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই পর্যায়ের চিত্রশিল্পের পর্যাপ্ত কোনো নিদর্শন আমাদের হাতে নেই । যাই হোক, সুলতানি আমলে পারস্য শিল্পরীতি ও ভারতীয় শিল্পরীতির একটা মেলবন্ধন ঘটেছিল । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি শিল্পরীতি অপর শিল্পরীতিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল । সুলতানি আমলে চিত্রাঙ্কনের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী কালে তা থেকে তিনটি স্বতন্ত্র শিল্পরীতি ও ঐতিহ্যের উদ্ভব ঘটেছিল । সেগুলি হল মুঘল, রাজস্থানি ও দক্ষিণী । সুলতানি আমলে জৈন চিত্রশিল্পীদের আঁকা কিছু ছবির নিদর্শন পাওয়া গেছে গুজরাট অঞ্চলে । গুজরাট ছাড়া রাজস্থান ও সৌরাষ্ট্রেও জৈন শিল্পীরা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ।

মুঘল আমলের চিত্রকলা (Art during the Mughal Period) : ভারতীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসে মুঘল যুগের একটি বিশিষ্ট অবদান আছে । সুলতানি শাসকেরা চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষক না হলেও মুঘল সম্রাটেরা চিত্রশিল্পের কদর করতেন । মুঘল চিত্রশিল্পের বিবর্তনে মুঘল-পূর্ব চিত্রশিল্পের প্রভাব ছিল ।

(১) চিত্রকলায় আকবরের অবদান :  আকবর চিত্রশিল্পের কদর করতেন বলে বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁর রাজদরবারে যোগদান করার জন্য ভিড় করতেন । আকবর হিন্দু শিল্পীদের খুব কদর করতেন । তাঁর রাজদরবারে ১৭ জন বিখ্যাত শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিল হিন্দু । এঁদের মধ্যে মুকুন্দ, কেশুলাল, মহেশ, তারা, যদু, জগন, রাম হরিবংশ প্রভৃতিরা ছিলেন বিখ্যাত । আকবর চিত্রশিল্পের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খুলেছিলেন । খাজা আব্দুস সামাদ ছিলেন এর প্রধান । কিন্তু আকবর নিজেই এই বিভাগের দেখাশোনা করতেন । পারস্য ও হিন্দুরীতির মিশ্রণে মুঘল শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল ।

(২) চিত্রকলায় জাহাঙ্গিরের আবদান : চিত্রকলার ইতিহাসে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের রাজত্বকাল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । জাহাঙ্গির চিত্রশিল্পের একজন বড়ো সমঝদার ছিলেন । তাঁর আমলে চিত্রকলায় পারস্য প্রভাব লুপ্ত হয়ে খাঁটি ভারতীয় চরিত্র ফুটে ওঠে । হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তিনি শিল্পীদের কদর করতেন । এইসব শিল্পীদের মধ্যে আগা রেজা ও তাঁর পুত্র আবুল হাসান, ফারুক বেগ মহম্মদ, নাদির মুরাদ মনসুর, আখারিজা, বিষেণ দাগা, কেশব, মনোহর, মাধব, তুলসী প্রভৃতির নাম বিখ্যাত । জাহাঙ্গিরের আমলে মানুষ ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি আঁকার ব্যাপক প্রসার শুরু হয় ।

(৩) চিত্রকলায় শহজাহানের অবদান : শাহজাহান অবশ্য পিতার মতো চিত্রকলায় আগ্রহী ছিলেন না । তাঁর আগ্রহ ছিল প্রধানত স্থাপত্যের দিকে । ফলে তাঁর আমলে চিত্রশিল্পী দরবারি অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় । তবে তাঁর পুত্র দারা শুকো ও দরবারের অভিজাত ব্যক্তি আসফ খান শিল্পানুরাগী ছিলেন । শাহজাহানের সময় মুঘল চিত্রকলার বহিরঙ্গের রূপ নিখুঁত হয়ে ফুটে ওঠে । কিন্তু পরে তা কিছুটা একঘেয়ে ও স্থিতিশীল হয়ে পড়ে । তাতে প্রাণের কোন স্পর্শই আর ছিল না । দারা শুকো বরং জাহাঙ্গিরি ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ছিলেন । জাহাঙ্গিরের মতো তিনিও পাখি ও গাছপালার অনুরাগী ছিলেন । তবে এক্ষেত্রেও অনুভূতির আবেদন ছিল নিষ্প্রাণ । শাহজাহানের আমলে প্রাকৃতিক দৃশ্যের পরিবর্তে সম্রাট ও মানুষের প্রতিকৃতি আঁকার দিকেই ঝোঁক বেশী ছিল ।

(৪) চিত্রকলায় ঔরঙ্গজেবের অবদান : চিত্রকলা সম্পর্কে ঔরঙ্গজেবের আগ্রহের অভাব থাকলেও শিল্পচর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় নি । বহু মুঘল রাজপুরুষ ও অভিজাত ব্যক্তি চিত্রশিল্পে আগ্রহী ছিলেন ।

আঞ্চলিক শিল্প : মুঘল দরবার ছাড়া আঞ্চলিক স্তরেও চিত্রশিল্পের চর্চা হত এবং রাজস্থান, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে কাংড়া, জম্মু, গুলের, ইত্যাদি চিত্রকলা, দাক্ষিণাত্যে তাঞ্জোর, বাংলা, নেপাল, ওড়িশা, অসম প্রভৃতি অঞ্চলেও নিজস্ব শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল । এর মধ্যে পৌরাণিক কাহিনী ও প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলম্বনে রাজস্থানি চিত্রগুলির রং এর কাজ আমাদের মুগ্ধ করে দেয় । কাংড়া চিত্রের বিষয় বস্তু ছিল কৃষ্ণলীলা, রাগমালা ইত্যাদি । এইসব আঞ্চলিক শিল্পরীতি বৈচিত্র্য ও উন্নত শিল্পকলার সাক্ষ্য দেয় ।

*****

Related Items

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব

ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন গিরিপথের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে নদনদীর প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে সমভূমির প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব ...

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

সাধারণভাবে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত্য অংশকে আর্যাবর্ত বা উত্তরাপথ ও বিন্ধ্যপর্বত থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত্য অংশকে দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিনাপথ বলা হয় । ভু-প্রকৃতির বৈশিষ্ট অনুসারে দেশকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে । ...

ভারতবর্ষ নামকরণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

ভারতবর্ষের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে । যেমন -পৌরাণিক যুগের সাগর বংশের সন্তান রাজা ভরতের নাম থেকে আমাদের দেশের নামটি এসেছে ভারত বা ভারতবর্ষ । বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে মহাসাগরের উত্তরে এবং বরফে ঢাকা পাহাড়ের দক্ষিণে অর্থাৎ হিমালয়ের ...

প্রতিবাদী আন্দোলন (Protest Movement)

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনেক মানুষ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়ে ফেলে । ফলে এই শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবাদী আন্দোলন ঘটে এবং নতুন নতুন ধর্মমতের উদ্ভব হয় । এর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম প্রধান ।

আর্যদের পরিচয় (Coming of The Aryans)

আর্যদের বসতি বিস্তার, ঋকবেদের আলোকে আর্য জনজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবন, পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিক কাঠাম, আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন, কৃষি ও পশুপালন, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প , আর্যদের ধর্মজীবন, পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্য জনজীবনে পরিবর্তন ...