সাতবাহন সাম্রাজ্য (Satabahanas dynasty)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 18:18

সাতবাহন সাম্রাজ্য (Satabahanas dynasty) :

দাক্ষিণাত্য ও মধ্য ভারতে মৌর্যদের প্রভাব খুবই কম ছিল । অশোকের মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যে মৌর্যদের আধিপত্য শেষ হয়ে যায় । কিন্তু যাতায়াতের অসুবিধা ও এখানকার অনুন্নত অর্থনীতি গোড়ার দিকে এই অঞ্চলকে বিদেশি আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখে । ফলে খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতক থেকে সাতবাহন বংশের রাজারা এই অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং প্রায় তিন শতক জুড়ে তাঁরা এই অঞ্চলে সগৌরবে রাজত্ব করেন । কিন্তু কুষাণদের আক্রমণে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে শকরা মালয়, কাথিয়াবাড় ও মহারাষ্ট্রের দিকে নজর দেওয়ায় তাদের সঙ্গে সাতবাহনদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল । সাতবাহন প্রাধান্য বিস্তারের পথে তারাই ছিল প্রধান অন্তরায় ।

আদি পরিচয় ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা (The Origin of the Satabahanas) : পুরাণে সাতবাহনদের অন্ধ্র বা অন্ধ্রভৃত্য বলা হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় সাতবাহনদের আদি বাসস্থান ছিল অন্ধ্রদেশ । এই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে । সিমুক ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা । এই বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণির আমলেই সাতবাহন সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর শক জাতির আক্রমণে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অতিত্ব বিপন্ন হয়েছিল ।

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (Gautamiputra Satakarni) (১০৬-১৩০) :

(ক) রাজ্যজয় (Gautamiputra Satakarni as a conqueror) : সাতবাহন সাম্রাজ্যের ঘোরতর বিপদের মুহূর্তে শক্ত হাতে হাল ধরেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীনাসিক প্রশস্তি থেকে তাঁর বিজয় কাহিনি জানা যায় । তিনি শক, গ্রিক ও পহ্লবদের শক্তি খর্ব করেছেন বলে দাবি করেছেন । তিনি শক ক্ষত্রপ নহপানকে পরাজিত করে রৌপ্যমূদ্রা থেকে তাঁর নাম অপসারিত করে নিজের নাম খোদাই করেন । তিনি শকদের কাছ থেকে মালব ও কাথিয়াবাড় দখল করে নেন । নাসিক প্রশস্তি থেকে আরো জানতে পারা যায় যে,পূর্বঘাট পর্বত থেকে পশ্চিমঘাট পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । উত্তরে মালব থেকে দক্ষিণে কানাড়া পর্যন্ত এলাকা তাঁর দখলে ছিল । কিন্তু তিনি শকদের ক্ষমতা পরোপুরি খর্ব করতে পারেন নি । টলেমির রচনা জুনাগড় শিলালিপি সুত্রে জানা যায় শকবীর রুদ্রদামন সাতবাহনদের পরাজিত করে মালব পুনরাধিকার করেন । এই পরিস্থিতিতে শকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে গৌতমীপুত্র রুদ্রদামনের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেন । গোঁড়া ব্রাহ্মণ গৌতমীপুত্র বাধ্য হয়ে রুদ্রদামনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে শক জাতির ভারতীয়করণ করেন । কাজেই এই বিবাহের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও সামাজিক তাৎপর্য ছিল ।

(খ) মূল্যায়ন (Evaluation) : গৌতমীপুত্র কেবল রণক্ষেত্রেই কৃতিত্বের পরিচয় দেননি; শাসক হিসেবেও তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন । দরিদ্র জনগণের সুবিধার জন্য তিনি করভার লাঘব করেছিলেন বলে জানা যায় । তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং ক্ষত্রিয়দের দর্প চূর্ণ করে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি বর্ণপ্রথার গোঁড়া সমর্থক ছিলেন এবং বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মেলামেশা বন্ধ করে দেন । কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে তিনি নিজেই শক রাজা রুদ্রদামনের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেন । এ থেকেই প্রমাণিত হয় তাঁর কাজে ও কথায় বিস্তর ফারাক ছিল । অবশ্য গোঁড়া ব্রাহ্মণ হলেও  গৌতমীপুত্র পরধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন না । তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা ও বৌদ্ধবিহার নির্মাণে সহায়তা করতেন ।

গৌতমীপুত্র পরবর্তী রাজারা (Successor after the death of Gautamiputra Satakarni) : গৌতমীপুত্রের পর তাঁর পুত্র বশিষ্ঠপুত্র পলুমায়ি (Vasishtiputra Pulamayi) সিংহাসনে বসেন । তাঁর রাজত্ব কালেও শকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ও কয়েকটি অঞ্চল সাতবাহনদের হস্তচ্যুত হয় । কিন্তু আত্মীয়তা থাকার ফলে শকেরা সাতবাহনদের ধ্বংশ থেকে বিরত থাকে । এই বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী রাজা ছিলেন যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী । তিনি কয়েকটি এলাকা শকদের কাছ থেকে পুনরাধিকার করেন । তাঁর মৃত্যুর পর সাতবাহন বংশের দ্রুত পতন শুরু হয় ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...