মুসলিমদের আগমনে সংঘাত ও সমন্বয়ী প্রক্রিয়া

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 09/15/2014 - 11:36

মুসলিমদের আগমনে সংঘাত (Conflict at the advent of Muslims) :

মুসলমানরা ভারতে একটি সম্পূর্ণ নতুন ও উন্নত ধর্ম চেতনা ও জীবনাদর্শ নিয়ে এসেছিল । দুটি সম উন্নত মানের ধর্ম ও সংস্কৃতি যখন মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তখন কেউ কাউকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারে না । প্রাথমিক সংঘাত অনিবার্য । এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । হিন্দু-মুসলমান পরস্পর পরস্পরকে বিধর্মীর দৃষ্টিতে দেখত । হিন্দুর কাছে মুসলমানরা ছিল অত্যাচারী, লুণ্ঠনকারী ও হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী ম্লেচ্ছ । মুসলিম শাসকেরা যেভাবে হিন্দু রাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিল এবং প্রশাসনে নিজেদের লোক বসিয়ে ছিল, সংস্কৃত ভাষা ও অন্যান্য ভাষার পরিবর্তে আরবি, ফরাসি ভাষার প্রচলন করেছিল, হিন্দুদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না । অন্যদিকে গোঁড়া উলেমা ও মুসলমানদের কাছে অমুসলমানরা ছিল কাফের বা জিম্মি । এরা দার-উল-ইসলাম বা ইসলামিক ধর্মরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল । কাজেই সংঘাত বা সংঘর্ষ এড়ানো ছিল কঠিন; সহাবস্থান ছিল কার্যত অসম্ভব ।

সমন্বয়ী প্রক্রিয়া (Undestanding Process) : দীর্ঘদিন ধরে দুটি ধর্ম ও সভ্যতা যখন পরস্পর ঘন সান্নিধ্যে আসে, তখন প্রথমে সংঘাত থাকলেও পরে ধীরে ধীরে একে অপরকে প্রভাবিত করতে থাকে । প্রথম দিকের উগ্র মনোভাব প্রশমিত হয়ে এলে উভয় সম্প্রদায়ই একে অপরের সম্পর্কে ক্রমশ শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে । অসহিষ্ণু মনোভাবের বদলে একটা বোঝাপড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় । সমন্বয়ী প্রবণতাগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে । মুসলমান সাধক ও ধার্মিক ব্যক্তিরা শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন । তেমনই হিন্দু যোগী ও পণ্ডিতরাও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভক্তি, শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল । সত্যপিরের আদর্শ বাংলার হিন্দু–মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই আকৃষ্ট করেছিল । কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই নয়, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল । শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের যোগ ও বেদান্ত দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও বিজ্ঞান পাঠ করত । হিন্দুরাও মুসলমানদের কাছ থেকে অঙ্ক, রসায়ন ও জ্যামিতি শিক্ষালাভ করত । কয়েকজন মুসলমান যেমন ভারতীয় ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন, তেমনই কয়েকজন হিন্দুও ফরাসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন । আবার হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ভাষা হিসাবে উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটে । পর্যায়ক্রমে এই সংঘাত ও সমন্বয়ের পরিণতিতে ভারতের সাংস্কৃতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় । এই উত্তরণের পিছনে কয়েকজন সুলতান যেমন, বাংলার হুশেন শাহ ও তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ, কাশ্মীরের জয়নাল আবেদিন, বিজাপুরের আদিল শাহ প্রভৃতির গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক অবদান ছিল । মুঘল আমলেও আকবর ও দারা শুকোর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ।

*****

Related Items

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক যুগের কী সম্পর্ক ছিল, তা বলা কঠিন। অনেকেই মনে করেন আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণকর্তা । বিষয়টি বিতর্কিত । কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে তফাত এত বেশি যে, দুটি সভ্যতা একই জাতি সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয় না । স্যার জন মার্শাল মনে করেন ...

সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক

সিন্ধু জনগণ কূপমন্ডূক ছিল না । সমকালীন অন্যান্য সভ্যতা মিশর, ব্যাবিলন ও সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু জনগণের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । সিন্ধু ও সুমেরীয় উভয় সভ্যতাই উন্নত নাগরিক জীবন ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বাক্ষর বহন করে । উভয় অঞ্চলের মানুষ ...

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilisation)

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন ...

ধাতুর আবিষ্কার ও তাম্রযুগ

নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর ...

মেহেরগড় সভ্যতা (Mehrgarh Civilisation)

হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন । সভ্যতার বৈশিষ্ঠ, মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব ...