মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 09/12/2014 - 11:32

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ (Causes of the Downfall of the Mughal Empire) :

ঔরঙ্গজেবের আমল থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল । ঔরঙ্গজেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যের বিশালায়তন অব্যাহত ছিল । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিভূত হয় । মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি হল—

(১) সম্রাটের অযোগ্যতা (Weakness of the Emperor) : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি আগাগোড়াই দুর্বল ছিল এবং যতদিন সম্রাটরা সবল ও দক্ষ ছিলেন, ততদিন এইসব দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা ফুটে ওঠার কোন সুযোগ পায়নি । সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল এর স্বৈরতন্ত্রী ও সামরিক শক্তি নির্ভর রাষ্ট্রকাঠামো । যে কোন স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের জীবনীশক্তি নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের দক্ষতা ও যোগ্যতার উপর । ঔরঙ্গজেব পরবর্তী সম্রাটদের অযোগ্যতার কারণে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্য দিল্লি ও আগ্রার সংকীর্ণ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় ।

(২) সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী আইনের অভাব সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের পরিপন্থী ছিল । ঔরঙ্গজেব নিজে তার ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে এই বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে । এই ধরনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সংঘাত সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছিল ।

(৩) অভিজাত শ্রেণীর দায়িত্বহীনতা ও স্বার্থপরতা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় । অভিজাতরা সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন । বিভিন্ন দল ও উপদলে ভাগ হয়ে তাঁরা সম্রাটদের হাতের মুঠোয় আনার চেষ্ঠা করেন । সম্রাটরাও অনেকক্ষেত্রে তাঁদের হাতের পুতুল হয়ে পড়েন । ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এবং সাম্রাজ্যের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা সর্বনাশ ডেকে আনেন ।

(৪) সামরিক দুর্বলতা (Military weakness) : সামরিক দুর্বলতা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী । বস্তুত, মুঘল সেনাবাহিনী কখনই সম্রাটের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না । সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকতেন মনসবদারেরা । মনসবদারেরা ঔরঙ্গজেবের আমলে প্রায় সবাই জায়গিরের দায়িত্বেও ছিলেন । এই সময় একদিকে মনসবদারের সংখ্যা বাড়ছিল, অন্যদিকে তারা ভালো জায়গির পাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল । এই পরিস্থিতি থেকেই উদ্ভূত হয় জায়গির সংকট । এই সংকট ক্রমশ প্রবল আকার ধারণ করে এবং তা মুঘল সাম্রাজ্যের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠে । এছাড়াও ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অন্যান্য নানা কারণে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছিল ।

(৫) অর্থনৈতিক সংকট (Financial Crisis) : দুর্বল অর্থনীতি, অনাবশ্যক ও বেহিসাবি অর্থব্যয় এবং আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টার অভাব মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল । অহেতুক যুদ্ধ, মুঘল দরবারে বিলাস বহুল জীবন ইত্যাদি নানা কারণে খরচ বাড়ছিল । কিন্তু আয় সেভাবে বাড়েনি । কৃষি, শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়নি । সব মিলিয়ে মুঘল অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়েছিল ।

(৬) মুঘল আমলের শেষ দিকে কৃষক অসন্তোষ ও বিদ্রোহ ছিল এক নিয়মিত ঘটনা । জায়গির হস্তান্তর, জায়গির সংকট কৃষকদেরও প্রভাবিত করেছিল । ক্রমশ জায়গিদারেরা, যাঁরা অন্যদিকে একসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মনসবদারও ছিলেন, তাঁরা কৃষকদের শোষণ করতে শুরু করেন । ইজারা প্রথার প্রবর্তনের ফলে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় । ফলে তৈরি হয় অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ— যা মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের পরিপন্থী ছিল ।

(৭) ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতি (Aurangzeb's religious policy) : ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী । তাঁর ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি, রাজপুত নীতি, জিজিয়াকর আরোপ ইত্যাদি রাজনীতি, অর্থনীতি ও জনজীবনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ।

(৮) বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ কারণে যখন মুঘল সাম্রাজ্য ও প্রশাসন জর্জরিত, তখন বৈদেশিক আক্রমণ এই সাম্রাজ্যের জীবনশক্তিকে একধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দেয় । নাদির শাহ বা আহম্মদ শাহ আব্দালির আক্রমণ ঠেকানোর মতো ক্ষমতা ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটদের ছিল না । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করার কার্যকরী কোন প্রচেষ্টাই এই সময় দেখা যায় নি ।

(৯) আঞ্চলিক বিদ্রোহ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ । রাজপুত শক্তি, মারাঠা শক্তি, শিখ বিদ্রোহ, আফগান বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের ভীত দুর্বল করে দিয়েছিল ।

(১০) সাম্রাজ্যের বিশালতা দীর্ঘদিন টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল । এতবড়ো সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যয়ও কম ছিল না । দিল্লি থেকে এই সাম্রাজ্যকে শাসন করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না । এছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা সমস্যাকে ঘনীভূত করেছিল ।

(১১) মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ইংরেজদেরও একটা ভূমিকা ছিল । ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়েছিল । সেই প্রথম ইংরেজরা মুঘল সম্রাটদের দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল । পরে ১৮৫৭ সালে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজ কর্তৃক নির্বাসিত হন । ফলে মুঘল সম্রাটদের দিন ফুরিয়ে আসে । ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজ রাজ । ভারতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও শূন্যতা, অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশৃঙ্খলা ও শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য এবং সর্বোপরি ভারতীয় শাসকশ্রেণির অন্তর্বিরোধ ও চরম দায়িত্বহীনতা তাদের সামনে সাম্রাজ্য স্থাপনের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় । পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের এই অবস্থা থেকে ভারতকে রক্ষা করার সাধ্য ছিল না । ইংরেজদের কূটনীতি, বিচক্ষণতা ও সুযোগসন্ধানী তৎপরতা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তিমলগ্ন ত্বরান্বিত করে ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প

মুঘল আমলে গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প বা কুঠির শিল্প । কুঠির শিল্পকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথমত, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং দ্বিতীয়ত অকৃষি শিল্প । কৃষিনির্ভর শিল্পের মধ্যে পড়বে শর্করা শিল্প, তৈল, তামাক, নীল, মদ প্রভৃতি শিল্প । ...

সুলতানি ও মুঘল আমলের চিত্রকলা

একটি সময় ছিল যখন মনে করা হত সুলতানি আমলে চিত্রকলার কোনো চর্চা হত না । ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল । বর্তমানে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে । আসলে ভারতে ইসলামের আর্বিভাবের ফলে যে সমন্বয়ী প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছিল, তা ভারতের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে ...

মুঘল যুগের স্থাপত্য

স্থাপত্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে মুঘল যুগের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । নির্মাতা হিসাবে মুঘল সম্রাটদের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া । এই যুগের স্থাপত্য ভারতীয় ও পারস্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল । মুঘল স্থাপত্যরীতির সুচনা হয় আকবরের সময়ে ...

সুলতানি যুগের স্থাপত্য

দিল্লির কুতুবমিনার (Qutb Minar) হল এয়োদশ শতকের মুসলিম স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন । সুফি সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল । কুতুবমিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করেন কুতুবউদ্দিন আইবক এবং সম্পূর্ণ হয় ইলতুৎমিসের আমলে । ...

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ :

ফার্গুসনের মতে, সুলতানি স্থাপত্যের প্রকৃতি ছিল ইন্দো-স্যারাসিনিক (Indo-Saracenic) বা পাঠান । আবার হ্যাভেলের মতে, এই শিল্পরীতির ‘দেহ ও আত্মা’ ছিল ভারতীয় । আসলে সুলতানি যুগের স্থাপত্য প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরী