মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ও সংহতি

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 09/11/2014 - 07:42

মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ও সংহতি

(ক) শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ : আকবরই মুঘল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । রাষ্ট্রশাসনে আকবর সরকারের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের মঙ্গলের কথাও চিন্তা করতেন । তাঁর প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতীয় ও সুলতানি শাসনের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল । বিশেষত শেরশাহ প্রবর্তিত শাসন-ব্যবস্থার অনেক কিছুই তিনি গ্রহণ করেছিলেন । এ দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁর শাসনব্যবস্থার মধ্যে হয়ত কোন অভিনবত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না । তবে আকবর যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, তা তাঁর শাসনব্যবস্থায় এক নতুন ব্যাপ্তি ও গভীরতার সঞ্চার করেছিল । তা ছাড়া পুরানো প্রথা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও, তিনি তাঁকে নিজস্ব চিন্তা ও ভাবধারার দ্বারা সুসংহৃত করে নেন । সুতরাং তাঁর কোন মৌলিক চিন্তাধারা ছিল না, এ কথা বলা সঙ্গত হবে না ।

(খ) স্বৈরতন্ত্র : মধ্যযুগের অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মতো তাঁর প্রবর্তিত শাসনও ছিল স্বৈরতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত । তবে এই স্বৈরতন্ত্র দায়িত্বহীন ছিল না । প্রজাকল্যাণ ছিল তাঁর আদর্শ । সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও আকবর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাস করতেন ও প্রশাসনিক কাজে মন্ত্রী ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের ওপর নির্ভর করতেন । তবে সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে সরকারি কাজকর্ম পরিচালিত হত ।  রাজকার্যে তাঁকে যারা সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে ভকিল (প্রধান মন্ত্রী), ওয়াজির বা দেওয়ান (রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত), মির বকসি (সামরিক বিভাগের প্রধান), কাজী (প্রধান বিচারপতি) ও সদর-উস-সুদুর (ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী) ছিলেন প্রধান ।

(গ) প্রাদেশিক শাসন : শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আকবর সমগ্র রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশ বা সুবায় বিভক্ত করেন । কেন্দ্রীয় শাসনের ধাঁচেই প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত । সুবাদার বা সিপাইসলার সুবার প্রশাসনিক ও সামরিক বিভাগের প্রধান ছিলেন । তাঁকে সাহায্য করার জন্য দেওয়ান, বকসি, ফৌজদার, কোতোয়াল, কাজি, আমিল প্রভৃতি সরকারি কর্মচারীরা ছিলেন । সুবাগুলি কয়েকটি সরকারে বা জেলায় বিভক্ত ছিল । সরকারের শাসন দায়িত্ব ছিল ফৌজদারের উপর । সরকারগুলিকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করা হত । পরগণার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন শিকদার । ফৌজদার ও শিকদারকে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী সাহায্য করতেন ।

(ঘ) বিচার বাবস্থা : বিচার বিভাগের প্রধান ছিল স্বয়ং সম্রাট । রাষ্ট্রে প্রধান কাজি ছিলেন বিচারের ভারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ কর্মচারী । তাঁর অধীনে অন্যান্য কাজীরা বিভিন্ন প্রাদেশিক শহরে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন । কাজিকে সাহায্য করার জন্য মুফতি ও মির আদল নামে দুজন কর্মচারী ছিলেন । সুবিচার সম্পর্কে আকবর নিজে খুব সচেতন ছিলেন ।  তিনি বলতেন ‘আমি যদি কোন অন্যায় করি, তাহলে আমি নিজে নিজের বিচার করব’ । বাদশার কাছে সরাসরি বিচারের জন্য প্রজাদের কাছে তাঁর দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত ছিল ।

*****

Related Items

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র (Indian Feudalism)

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র একটি অত্যন্ত ব্যাপক, জটিল ও বিতর্কিত বিষয় । সাধারণত ‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি মধ্যযুগে ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়ে থাকে । বর্বর আক্রমণের এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে নবম শতকে এই প্রতিষ্ঠানটি বিকশিত হয়েছিল মূলত পশ্চিম ইউরোপে । ভূমিকেন্দ্রিক ও ভূমিনির্ভর ...

প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন

প্রাচীন ভারতে কৃষিই ভারতের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা ছিল । আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এবং আর্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি । ঋকবৈদিক যুগে পশুচারণই ছিল আর্যদের প্রধান উপজীবিকা এবং গো-সম্পদ ছিল ধনসম্পত্তির মাপকাঠি । ধনী ব্যাক্তিকে বলা হত ‘গোমৎ’ । ...

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের স্থান

বৈদিক যুগে নারীর স্থান: প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান নিয়ে বিতর্ক আছে । সাধারণভাবে বলা হয় বৈদিক যুগে নারীর স্থান ছিল খুব উপরে । পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত হলেও তার যত্ন ও লালনপালনে কোনো ত্রুটি থাকত না । ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারার ...

জাতি ভেদ প্রথা (Caste System)

বৈদিক যুগ : আর্যরা প্রথম দিকে যাযাবর ছিল । পরে তারা আগুন লাগিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ক্রমশ তারা কৃষিকাজ করতে শিখে । প্রথমের দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগ বলে কিছু ছিল না । সব কিছু ছিল যৌথ । এই সময় ...

বিদেশি আগমন ও হিন্দু সমাজে গতিশীলতা

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে ব্যাকট্রীয়, গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ ও আরও পরে হুন প্রভৃতি বিদেশি জাতির আগমনের ফলে ভারতীয় সমাজে তার প্রভাব পড়ে । এইসব বিদেশির মধ্যে অনেকেই ভারতে থেকে যান, বিবাহ করেন এবং ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভুত হয়ে যান । ...