ভক্তি আন্দোলন (Bhakti Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 09/19/2014 - 07:53

ভক্তি আন্দোলন (Bhakti Movement) :

প্রেক্ষাপট : ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয় । হিন্দুরা অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । ধর্মান্তরকরণের কাজ অবশ্য ধীরে ধীরে চলছিল । তবুও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান । এই ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া হয়তো হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন করেনি, তবুও এই প্রক্রিয়া হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । আত্মরক্ষা ও সমালোচনার প্রযোজন অনুভূত হয়েছিল । হিন্দুধর্ম ও সমাজের কিছু কুপ্রথা ও রীতিনীতি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল । অন্যদিকে ইসলামের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভ্রাতৃত্ববোধ হিন্দুদের গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল । ফলে হিন্দুদের মধ্যে এক উদারনৈতিক ধর্ম আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক জনগণের মধ্যে প্রেম, মৈত্রী, ভালোবাসা ও ভক্তির বাণী প্রচার করতে থাকেন । এই ধর্ম আন্দোলনই ভক্তিবাদ নামে পরিচিত । এইসব ধর্মপ্রচারক প্রচার করেন যে, সমস্ত ধর্মই সমান ও ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় । অত্যধিক প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখন্ড ভক্তি ও শ্রদ্ধাই মুক্তির পথ বলে তাঁরা মনে করতেন । তাঁরা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার কাজের উপর, জন্মের উপর নয় ।

ভক্তিবাদের লক্ষ্য ও আদর্শ : ভক্তিবাদের মূল কথা হল ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন ও অধ্যাত্মবাদ । মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যেও ঈশ্বর বা বুদ্ধ-আরাধনার আদর্শ উচ্চারিত হয়েছে । গুপ্ত যুগে রামায়ণ ও মহাভারত নতুন করে রচিত হওয়ায় তখন জ্ঞান ও কর্মের সঙ্গে ভক্তিকেও আত্মার মুক্তির পথ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল । সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল । সেখানে বলা হয়েছিল, ঈশ্বর ভক্তিই মুক্তির পথ । জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা দূর করে ঈশ্বরে ভক্তি ও শ্রদ্ধার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল । কাজেই ভক্তিবাদের আদর্শ সুলতানি সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের আগেই প্রচলিত ছিল । তবে ইসলামের সংস্পর্শে আসার ফলে ভক্তিবাদ এক নতুন মাত্রা পায় । চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ভক্তিবাদের প্রসার তার সাক্ষ্য দেয় । ইসলামের মানবতাবাদ, সুফি মতাদর্শ ও ভ্রাতৃত্ববোধ হিন্দুদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল । বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক এই সময়ে ভক্তিবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছিল ।

ভক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব ও প্রভাব :

(১) ভক্তিবাদের প্রবক্তারা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে এসেছিলেন । এঁদের মধ্যে অনেকেই কারিগর সম্প্রদায়ের মানুষ অথবা মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন । কোনো কোনো ব্রাহ্মণ ভক্তিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও সাধারণভাবে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ।

(২) ভক্তিবাদ হিন্দু ও মুসলমান জনগণকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে । অনেকে মনে করেন, এর প্রভাব সমাজের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই যথেষ্ট গোঁড়ামি ছিল । এর ফলে জাতিভেদ প্রথায় কোনো বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়নি । কালক্রমে কবিরের অনুগামীরা কবিরপন্থী নামে এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয় । নানকের আদর্শ শিখ ধর্মের জন্ম দেয় । কাজেই ভক্তিবাদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে ।

(৩) কিন্তু এর সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, ভক্তিবাদ সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়নি । এর প্রবক্তাগণ যে মানবতাবোধ ও ধর্মীয় চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, তা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়ামির ওপর একটা বড় আঘাত হেনেছিল । পরবর্তী কয়েক শতকেও এর প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল ।

*****

Related Items

শাহজাহানের রাজত্বকাল (The Reign of Shahjahan)

পরবর্তী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পুত্র শাহজাহানের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যবাদী নীতি অব্যাহত ছিল। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল দাক্ষিণাত্য বিজয় । পিতা ও পিতামহের অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পূর্ণ করেন । সুন্নি মতাবলম্বী ও শাহজাহানের কাছে শিয়া মতাবলম্বী দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির ...

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল (The Reign of Jahangir)

আকবর তাঁর বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, উদারতা ও দূরদর্শিতায় মুঘল সাম্রাজ্যকে যে গৌরব শীর্ষে উন্নীত করে যান, পরবর্তী কালে তার উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গিরের আমলে তা মোটের উপর অক্ষুণ্ণ ছিল । অবশ্য পরবর্তী যুগের কিছু দুর্বলতা ও সমস্যার বীজ এই সময়েই অনুসন্ধান করা সম্ভব । ...

আকবরের রাজত্ব কাল (The Age of AKbar)

এক চরম সংকটজনক মুহূর্তে আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তখন তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হিমুকে দমন করা । হিমু ছিলেন চুনার থেকে বাংলা সীমান্ত পর্যন্ত তামাম এলাকার শাসক আদিল শাহের উজির । হিমু আগ্রা অধিকার করে দিল্লির অভিমুখে রওনা হন । ...

শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)

শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ । তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গিরদার । ফরিদের বাল্যজীবন সুখের ছিল না । বিমাতার কোপে পড়ে তিনি সাসারাম ছাড়তে বাধ্য হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ ...

হুমায়ুন ও মুঘল আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা

বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন ১৫৩০ সালে পিতার সিংহাসন আরোহণ করেন । কিন্তু তিনি যে জটিল সমস্যা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তা মোকাবিলা করার যোগ্যতা তাঁর ছিল না । দিল্লির শিশু রাষ্ট্রের ভিত ছিল খুবই দুর্বল । তখনও কোনো শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি । আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না । ...