প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 09:55

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি :

ধর্ম : একটা সময় ছিল যখন প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে ‘হিন্দুযুগ’ বলে অভিহিত করা হত । প্রাচীন ভারতে বৈদিক, ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দুধর্মই একমাত্র ধর্ম ছিল না । বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জন্ম প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবনকে জটিল করেছিল । কোনো সময় বৌদ্ধধর্ম, আবার কোনো সময় হিন্দু ধর্ম রাজানুগৃহীত হয়েছে । সাধারণভাবে ভারতের রাজা বা শাসক সম্প্রদায় সহিষ্ণু ও উদার ছিলেন এবং ইউরোপের মতো রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম— এই নীতি অনুসৃত না হলেও সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি সবসময় অখুন্ন ছিল না । হিন্দুদের হাতে বহু বৌদ্ধ মঠ ও বিহার ধ্বংস হয়েছিল । ‘বৃহদ্ধর্ম’ পুরাণে বলা হয়েছিল— বৌদ্ধরা বলপূর্বক দাহিত হয়ে মরবে । সত্য সত্যই বৌদ্ধদের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল কিনা, তার কোনো প্রমাণ অবশ্য নেই । পরে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং বৌদ্ধদের হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ এবং জৈন উভয় ধর্মই তাদের প্রাধান্য ও গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছিল ।

(১) জৈনধর্ম মত ও পথের বিভাগ : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক ধর্মেই মতভেদ দেখা দেয় এবং তা থেকে দুই বা ততোধিক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে । খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষার্ধে দক্ষিণ বিহারে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বহু জৈন ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে মহীশূর চলে যান । এদিকে পাটলিপুত্রে এক ধর্ম সম্মেলনে জৈন ধর্মের মূল সূত্রগুলিকে সংকলিত করা হয় । এই সংকলন দ্বাদশ অঙ্গ নামে পরিচিত । এরপর খ্রিস্টীয় পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতকে গুজরাটের বলভিতে আর একটি ধর্ম সভায় জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি আবার সংকলিত হয় । ফলে দ্বাদশ অঙ্গ ছাড়া উপাঙ্গ, মূলসূত্র ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত হয় । ভদ্রবাহুর শিষ্যরা পরে উত্তর ভারতে ফিরে এসে এইসব অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলতেন এবং বস্ত্র পরিধান করতেন না । এঁদের বলা হত দিগম্বর । যারা এই নির্দেশ উপেক্ষা করে শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন, তাদের বলা হত শ্বেতাম্বর । এই ভাবে জৈনরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । মূল আদর্শ নিয়ে উভয়ের মধ্যে তেমন তীব্র মতভেদ নেই ।

(২) বৌদ্ধধর্ম মত ও পথের বিভাগ : কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় । পর পর কয়েকটি ধর্ম সম্মেলন আহ্বান করা হয় । রাজগৃহে বুদ্ধের দেহত্যাগের কিছু পরেই প্রথম ধর্ম সম্মেলন বসে । এর প্রায় ১০০ বছর পরে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি বসে । পাটলিপুত্রে তৃতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন স্বয়ং অশোক । কণিষ্কের সময় কাশ্মিরে চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতির আসর বসে । এই সম্মেলনে বৌদ্ধরা হীনযান এবং মহাযান— এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান । গোঁড়া হীনযানরা মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতেন না । অষ্টাঙ্গিক মার্গকেই তারা মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করত । মহাযানরা মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করত এবং ব্যক্তির মুক্তির পরিবর্তে সমষ্টির মুক্তির উপর জোর দিত ।

(৩) হিন্দুধর্ম মত ও পথের বিভাগ : হিন্দুধর্মেও মতভেদ পরিলক্ষিত হয় ও এই বিভাগ বা ধারা ছিল পাঁচটি— (১) বৈষ্ণব, (২) শৈব, (৩) শাক্ত, (৪) সৌর, (৫) গাণপত্য । গুপ্তযুগে এই পাঁচটি ধারা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিল । এইসব সম্প্রদায় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান মেনে চললেও প্রত্যেকে ভক্তিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । অন্য দিকে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ উপাস্য দেবতার আরাধনা করলেও বাকিদের উপেক্ষা করতেন না । গুপ্তপরবর্তী যুগে হিন্দু দেব-দেবীর মধ্যেও যেন এক ধরণের বর্ণ ভেদ দেখা দেয় । কোনো কোনো দেব-দেবীর স্থান হয় উঁচুতে, কারোও বা নিচে । যেমন— বিষ্ণু, শিব, এবং দূর্গা ছিলেন প্রধান দেব-দেবী । অন্যান্যদের স্থান ছিল নিচে তাঁদের অনুচর হিসাবে । শিল্প ও সাহিত্যেও এর প্রতিফলন ঘটেছিল । একই ভাবে সেবাইতরাও বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল । সবার উপরে ছিলেন আচার্য্য । একজন রাজপুত্রের মতো তাঁরও অভিষেক হত । খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে হিন্দু ধর্মে তান্ত্রিকদের উদ্ভব ঘটেছিল । তান্ত্রিকদের মধ্যে নারী ও শূদ্রদেরও ঠাঁই হয়েছিল । উপজাতিদের হিন্দু ধর্ম ও সমাজে গ্রহণ করবার ফলে তান্ত্রিক মতবাদের উদ্ভব ঘটেছিল । বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও তান্ত্রিক মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ।

*****

Related Items

তৈমুর লঙ্গের ভারত আক্রমণ

ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লী সুলতানির পতন আসন্ন হয়ে পড়ে । ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর লঙ্গের ভারত আক্রমণ এই পতনের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে । তৈমুর লঙ্গের ভয়ে সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যান । তৈমুরের আক্রমণ দিল্লি সুলতানির অন্তসার ...

ফিরোজ শাহ তুঘলক (Firuz Shah Tughluq)

মহম্মদ বিন তুঘলকের পর তাঁর খুড়তুতো ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহসনে বসেন । তিনি আমির, ওমরাহ এবং ধর্মীয় নেতাদের অনুরোধে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন । কিন্তু বিজেতা বা শাসক হিসাবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি । মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন ন্যায় পরায়ণ,..

মহম্মদ বিন তুঘলক

খলজি বংশের অবসানের পর তুঘলকি আমল শুরু হয় । তুঘলকি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিয়াস উদ্দিন তুঘলক । গিয়াস উদ্দিনের পুত্র মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১) ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান । সম্ভবত তিনি তাঁর পিতাকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ...

খলজি বংশ ও আলাউদ্দিন খলজি

১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যু হয় । তারপর তাঁর উত্তরাধিকারীদের হত্যা করে প্রধান সেনাপতি জালালউদ্দিন খলজি ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান হন । জালালউদ্দিন খলজির দিল্লি দখলের সঙ্গে সঙ্গে দাস বংশের অবসান ঘটে ও খলজি বংশের সূচনা হয় । ...

গিয়াসউদ্দিন বলবন (Ghias-ud-din Balban)

গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর ইলবেরি তুর্কিজাত সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সিংহাসনে আরোহণ করার পরে গিয়াসউদ্দিন বলব্ন এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন ...