নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 11/01/2014 - 22:27

নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব :

সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ও ব্যর্থতা : প্রথমদিকে সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ছিল আশাতীত । তিনি বিনা রক্তপাতে মাসি ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে নজরবন্দি করেন । অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলিবর্দি খানের দ্বিতীয় কন্যার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব সৌকত জঙ্গকে মনিহারির যুদ্ধে পরাজিত করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন । তার আগেই তিনি ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন কলকাতা দখল করে ইংরেজদের উচিৎ শিক্ষা দেন । এই কলকাতা দখলের সঙ্গে বহু বিতর্কিত হলওয়েল উদ্ভাবিত অন্ধকূপ হত্যার কাহিনি প্রচলিত আছে । একটি রুদ্ধ কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করা হয়েছিল । জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে নাকি এদের মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যু হয় । অনেক ঐতিহাসিকই এই কাহিনির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন । অন্ধকূপ হত্যার জন্য সিরাজ-উদ-দৌলার কোন প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ছিল বলে মনে করা হয় না । যাই হোক, সিরাজ-উদ-দৌলার এই সাফল্য ছিল কিন্তু সাময়িক । ইংরেজরা কলকাতা পুনরাধিকার করে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি সিরাজ-উদ-দৌলাকে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে । পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ইংরেজদের হাতে ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরের পতন । ইতিমধ্যে মিরজাফরের নেতৃত্বে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণের জন্য চক্রান্ত করে । ইংরেজরাও এই চক্রান্তের শরিক হন । এরপর ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে লর্ড কাইভের হাতে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ঘটে । ইংরেজদের আজ্ঞাবহ পুতুল মিরজাফর বাংলার মসনদে বসেন ।

পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব : পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব নিয়ে আবেগের কোন অবকাশই নেই । এর ফলে আইনত বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হয়নি বা বাংলায় ইংরেজ শাসক প্রবর্তিত হয়নি ।

(১) বাংলার শাসনে ইংরেজদের অদৃশ্য হাত : বাংলার নতুন নবাব হলেন মীরজাফর । তবে তিনি ইংরেজদের আজ্ঞাবহ । ফলে শাসনের দায়িত্ব না নিয়েও আসল ক্ষমতা চলে গেল ইংরেজদের হাতে । সেই অর্থে বাংলার আর স্বাধীনতা রইল না ।

(২) ইংরেজদের অবৈধ ব্যবসা : মিরজাফর ইংরেজদের অবৈধ ব্যবসা মেনে নিলেন । এর ফলস্বরূপ দেশীয় বণিকদের চরম ক্ষতি হল । কিন্তু মিরজাফরের কিছু করবার রইল না ।

(৩) পলাশির লুন্ঠন : কোম্পানির কর্মচারীদের লোভের সীমা-পরিসীমা ছিল না । বাংলার অফুরন্ত ধনসম্পদ তারা নানাভাবে লুন্ঠন করতে লাগল । নানা অজুহাতে তারা মিরজাফরের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে থাকল । ফলে বাংলার জনগণের দুঃখ দুর্দশার সীমা রইল না । ১৭৬০ এর দশক তাই বাংলার ইতিহাসে ‘পলাশি লুন্ঠনের যুগ’ বলে পরিচিত হয়ে রইল । ইংরেজরা বুঝল রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর মতো লাভজনক ব্যবসা আর নেই । এই দিক দিয়ে বিচার করলে পলাশির যুদ্ধের রাজনৈতিক ফল অপেক্ষা অর্থনৈতিক ফল আরও গুরুত্বপূর্ণ ।

*****

Related Items

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র (Indian Feudalism)

ভারতীয় সামন্ততন্ত্র একটি অত্যন্ত ব্যাপক, জটিল ও বিতর্কিত বিষয় । সাধারণত ‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি মধ্যযুগে ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়ে থাকে । বর্বর আক্রমণের এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে নবম শতকে এই প্রতিষ্ঠানটি বিকশিত হয়েছিল মূলত পশ্চিম ইউরোপে । ভূমিকেন্দ্রিক ও ভূমিনির্ভর ...

প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন

প্রাচীন ভারতে কৃষিই ভারতের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা ছিল । আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এবং আর্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি । ঋকবৈদিক যুগে পশুচারণই ছিল আর্যদের প্রধান উপজীবিকা এবং গো-সম্পদ ছিল ধনসম্পত্তির মাপকাঠি । ধনী ব্যাক্তিকে বলা হত ‘গোমৎ’ । ...

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের স্থান

বৈদিক যুগে নারীর স্থান: প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান নিয়ে বিতর্ক আছে । সাধারণভাবে বলা হয় বৈদিক যুগে নারীর স্থান ছিল খুব উপরে । পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত হলেও তার যত্ন ও লালনপালনে কোনো ত্রুটি থাকত না । ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারার ...

জাতি ভেদ প্রথা (Caste System)

বৈদিক যুগ : আর্যরা প্রথম দিকে যাযাবর ছিল । পরে তারা আগুন লাগিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ক্রমশ তারা কৃষিকাজ করতে শিখে । প্রথমের দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগ বলে কিছু ছিল না । সব কিছু ছিল যৌথ । এই সময় ...

বিদেশি আগমন ও হিন্দু সমাজে গতিশীলতা

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে ব্যাকট্রীয়, গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ ও আরও পরে হুন প্রভৃতি বিদেশি জাতির আগমনের ফলে ভারতীয় সমাজে তার প্রভাব পড়ে । এইসব বিদেশির মধ্যে অনেকেই ভারতে থেকে যান, বিবাহ করেন এবং ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভুত হয়ে যান । ...