কুষাণ সাম্রাজ্য (Kushana Dynasty)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 18:13

কুষাণ সাম্রাজ্য (Kushana Dynasty) :

আদি ইতিহাস (Kushana Invasion) : মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । মৌর্যদের পর তারাই প্রথম একটি বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল । কুষাণদের ভারতে প্রবেশের ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে ইউ-চি নামে এক যাযাবর জাতি বাস করত । হিউঙ-নু নামে অপর এক যাযাবর জাতির তাড়া খেয়ে তারা সিরদরিয়া নদীতীরবর্তী অঞ্চলে এসে, সেখান থেকে শকদের বিতাড়িত করে বসবাস করতে শুরু করে । ইউ-চি -দের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে শক -রা ব্যাকট্রিয়ায় বসতি স্থাপন করে । কিন্তু হিউঙ-নুরা এই অঞ্চল থেকেও ইউ-চি -দের উৎখাত করায় তারা আবার শকদের ব্যাকট্রিয়া থেকে উৎখাত করে । শকেরা বাধ্য হয়ে ভারত আক্রমণ করে । ব্যাকট্রিয়ায় আসার পর ইউ-চি -দের দলগত সংহতি বিনষ্ট হয় ও তারা পাঁচটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় । কুষাণরা ছিল এই পাঁচ গোষ্ঠীর অন্যতম । চৈনিক ঐতিহাসিক সুমা-কিয়েনের মত অনুযায়ী কুজল কদফিসেস নামে জনৈক ইউ-চি ঐ পাঁচটি গোষ্ঠীকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন ও ভারতে প্রবেশ করে কাবুল ও কাশ্মীর দখল করেন । এই কুজুল কদফিসেস ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা । কুজুল কদফিসেস মারা গেলে তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস রাজা হন ।

কণিষ্ক (Kanishka) : কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা । তাঁর সঙ্গে কুজুল ও বিম কদফিসেসের কী সম্পর্ক ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । অনেকে মনে করেন তাঁর সঙ্গে এই বংশের প্রথম দুটি রাজার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না । কণিষ্কের আমলেই কুষাণ সাম্রাজ্য সর্বাপেক্ষা বেশি বিস্তার লাভ করে ও উত্তর ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কণিষ্কের সিংহাসন আরোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে । তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন ৭৮ খ্রিস্টাব্দে “শকাব্দ” নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক । এই সূত্র অনুসারে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন ।

(১) রাজ্যজয় (Extension of Empire) : কণিষ্কের রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্যের সঠিক সীমারেখা স্পষ্ট নয় । হিউয়েন সাঙের বা সুয়ান সাঙের মতে কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ায় । প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে জানা যায় তাঁর রাজ্য গান্ধার ও সুইবিহার থেকে পূর্বে অযোধ্যা ও বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । কলহনের রচনা থেকে জানা যায় কাশ্মীর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । সাকেত ও পাটলিপুত্রের রাজাদের সঙ্গেও তাঁর সংঘর্ষের কথা সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায় । কারো কারো মতে বিহার ও বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্র ও কাথিয়াবাড়ে কুষাণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে দাবি করা হয় । কিন্তু এখানকার শক ক্ষত্রপরা সত্য সত্যই কণিষ্কের অধীনতা মেনে চলতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে । বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয় কণিষ্কের সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে সাঁচী ও পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।

(২) ভারতের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তার (Extension of Empire outside India) : ভারতের বাইরে কণিষ্ক তাঁর সাম্রাজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। দাবি করা হয় যে, তিনি পার্থিয়ান ও চিনদের পরাজিত করেন এবং কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটান অধিকার করেন । তিনি সম্ভবত মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত গোবি মরুভূমি পর্যন্ত স্থান নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায়, তিনি চিনের সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পূর্ব তুর্কিস্থান দখল করেন । কিন্তু পরে তিনি চিনাদের হাতে পরাজিত হন । চিনের বিরুদ্ধে তাঁর সংঘর্ষের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না । তবে অনুমান করা যায় যে, চিনে তাঁর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি ।

(৩) ধর্মমত (Spread of Buddhism) : ভারতের ইতিহাসে কণিষ্কের স্থান ও গুরুত্ব অবশ্য কেবল মাত্র একজন কৃতি ও দক্ষ সেনানায়ক হিসাবে নয় । বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের জন্যই কণিষ্ক চিরস্মরণীয় হইয়ে থাকবেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন । অশোকের পর তাঁর সময়েই বৌদ্ধধর্ম পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে । তাঁর সময়ে বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান- এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় । ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে কণিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে । স্মিথের মতে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় অশোক । বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল ছিলেন ।

(৪) শিল্প ও সংস্কৃতি (Art and Culture) : সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কণিষ্ক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন । বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধ সাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই আবির্ভুত হয়েছিলেন । তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন । তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল ।

(৫) কৃতিত্ব (Achievement) : বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ও গুপ্তযুগের অভ্যুত্থানের আগে ভারত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নরপতির মর্যাদা কণিষ্কেরই প্রাপ্য । তবে প্রশাসক হিসাবে কণিষ্কের মূল্যায়ন করা সহজসাধ্য কাজ নয়, কারণ তাঁর রাজ্যশাসন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবিই সীমিত । তবে অনুমান করা যেতে পারে শাসক হিসাবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন । নচেৎ এত বড়ো সাম্রাজ্য তিনি টিকিয়ে রাখতে পারতেন না । বিদেশি হলেও কণিষ্ক যে ভাবে ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, তাঁর সেই আন্তরিকতা উচ্চ প্রশংসার যোগ্য ।

কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন (Fall of Kusana Empire) : কণিষ্কের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয় ।

(১) বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ পরবর্তী রাজাদের যোগ্যতা কখনোই কণিষ্কের মতো ছিল না । বিশেষত শেষ দুজনের আমলে কুষাণরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে । এই সুযোগে অসংখ্য আঞ্চলিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয় । উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহে শামিল হয় । পশ্চিম ভারতে শকগণ স্বাধীনতা লাভ করে ।

(২) এর পাশাপাশি ছিল বাণিজ্যিক অবক্ষয় । কুষাণদের পতনের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি অন্যতম কারণ ।

(৩) অধ্যাপক ব্রতীন মুখপাধ্যায়ের মতো আবার অনেকে বৈদেশিক আক্রমণকে বড়ো করে দেখেছেন । পারস্যের সাসনীয় সম্রাটদের হাতে কুষাণরা পরাস্ত হয় । অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি, বৈদেশিক আক্রমণ— সব মিলিয়ে কুষাণ সাম্রাজ্য ক্রমশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...