আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - পশ্চিম ও উত্তর ভারত

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 21:43

বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - পশ্চিম ও উত্তর ভারত :

বলভীর মৈত্রিক বংশ (Maitrakas dynasty of Valbhi) :

ভট্টারক পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে বলভীর মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শাসক হলেন প্রথম শিলাদিত্য, দ্বিতীয় ধ্রুবসেন ও চতুর্থ ধ্রুবসেন ।  দ্বিতীয় ধ্রুবসেন কনৌজের অধিপতি হর্ষবর্ধনের হাতে পরাজিত হন । এরপর বলভী রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে সপ্তম শিলাদিত্যের সময় আরবদের হাতে বলভীর পতন ঘটে ।  

যশোধর্মণ (Yasodharman) : গুপ্ত বংশের পতনের সুযোগে মান্দাশোরে যশোধর্মণ নামে একজন সামন্তরাজ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন । তিনি হুন রাজ মিহিরকুল বা মিহিরগুলকে পরাজিত করেন । মান্দাশোর লিপি থেকে জানা যায় তিনি সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে আরব সাগর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন । তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই রাজবংশের পতন ঘটে ।

কনৌজের উত্থান মৌখরী বংশ (Rise of Kanauj and Maukhari Dynasty) : গুপ্ত পরবর্তী যুগে মগধের পরিবর্তে কনৌজ ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয় । কনৌজ অবশ্য মগধের মতো কোনো সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে নি । হরিবর্মণ কনৌজে মৌখরী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি মহারাজ উপাধি গ্রহণ করেন । মৌখরী বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলের ইষাণবর্মণ । তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন । তাঁর রাজ্য গৌড় ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অন্ধ্রের কিছু অংশও তাঁর অধিকারে ছিল, তিনিও হুনদের পরাজিত করেছিলেন বলে মনে করা হয় । এই বংশের এক জন রাজা গ্রহবর্মণ থানেশ্বরের পূষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন । গ্রহবর্মণ গৌড়রাজ শশাঙ্কের হাতে নিহত হন । প্রভাকরবর্ধনের পুত্র রাজ্যবর্ধনও তাঁর হাতে পরাজিত ও নিহত হয় । তখন রাজ্যবর্ধনের ভাই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ আছে । যাই হোক, কনৌজের সিংহাসন শূন্য হওয়ায় কনৌজ হর্ষের রাজ্যভুক্ত হয় ।

পুষ্যভূতি বংশ ও হর্ষবর্ধন (Pushyabhuti Dynasty and Harshavardhana) : (৬০৬ - ৬৪৬/৪৭) : থানেশ্বরের পুষ্যভুতিবংশের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কনিষ্ঠ পুত্র হর্ষবর্ধন এক চরম সংকটের মুহুর্তে সিংহাসনে বসেন । তিনি একই সঙ্গে থানেশ্বর ও কনৌজের সিংহাসন লাভ করেন । ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করলেও যতদিন শশাঙ্ক জীবিত ছিলেন, ততদিন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি । তাঁর মৃত্যুর পর তিনি মগধ, গৌড়, ওড়িশা ও কঙ্গোদ নিজ রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি বলভিরাজ ধ্রুবসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করেন । হর্ষবর্ধন তাঁর কন্যার সঙ্গে ধ্রুবসেনের বিবাহ দেন এবং বলভির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন । এদিকে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে পরাজয়ের ফলে তাঁর দক্ষিণ ভারত অভিযান ব্যর্থ হয় । উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল তিনি কুক্ষিগত করেছিলেন বলে চালুক্যলিপিতে তাঁকে “সকলোত্তরপথনাথ” বলা হয়েছে । হিউয়েন-সাঙ তাঁকে “পঞ্চভারতের অধিপতি” বলে উল্লেখ করেছেন । উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা পর্যন্ত এবং পূর্বে গঞ্জাম থেকে পশ্চিমে বলভী পর্যন্ত সমগ্র এলাকা হর্ষবর্ধনের অধীন ছিল । দয়ালু, শিক্ষানুরাগী ও বিদ্যোৎসাহী নরপতি হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল । তিনি রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা নামে দুটি নাটক রচনা করেছিলেন ।

প্রতিহার বংশ (Pratihar Kingdom) : হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রতিহার বংশ উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রভাবশালী হয়ে পড়ে । প্রতিহার বা গুর্জর প্রতিহাররা ছিল রাজপুত জাতির একটি শাখা । এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হরিচন্দ্র, কিন্তু বৎসরাজের আমলেই প্রতিহাররা একটি সর্বভারতীয় শক্তিতে উন্নীত হয় । তিনি ধর্মপাল ও ধ্রুবর সঙ্গে কনৌজের দখল নিয়ে একটি ত্রি-শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন । তিনি ধর্মপালকে পরাজিত করেন এবং ধ্রুবর হাতে পরাজিত হন । বৎসরাজের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্টের আমলেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত ছিল । এ ক্ষেত্রেও ধর্মপাল পরাজিত হলেও রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দের হাতে নাগভট্টের পরাজয় ঘটে । প্রথম ভোজ বা মিহিরভোজ ছিলেন এই বংশের  সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা । কনৌজের অধিকার নিয়ে যে ত্রি-শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত প্রতিহাররা জয়লাভ করে ও তারা কনৌজ অধিকার করে । কিন্তু মহীপালের আমলে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় ইন্দ্র কনৌজ ধ্বংস করে প্রয়াগ পর্যন্ত অগ্রসর হন, মহীপালের পর প্রতিহারদের পতন শুরু হয় । সুলতান মামুদ কনৌজ লুন্ঠন করেন । চান্দেলদের হাতে প্রতিহারদের পতন সম্পূর্ণ হয় ।

অন্যান্য শক্তির উদ্ভব : হর্ষের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে অন্যান্য যে সব শক্তির উদ্ভব ঘটে, তাদের মধ্যে রাজপুত, আজমির ও দিল্লির চৌহান বংশ, চান্দেল, চেদী, পারমার প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য ।

*****

Related Items

সুলতান মামুদ (Sultan Mahmud of Gazni)

মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু জয়ের ৩০০ বছর বাদে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গজনির সুলতান মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন । সুলতান মামুদ একজন লোভী, লুন্ঠনকারী, রূপেই পরিচিত । ভারতে রাজ্য স্থাপনের কোনো ইচ্ছা তার ছিল না । ইসলাম ধর্মের প্রসার ...

আরবদের সিন্ধু বিজয়

হজরত মহম্মদ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন ও ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন । হজরত মহম্মদ মারা যাওয়ার পর একশো বছরের মধ্যে আরবরা পারস্য দখল করে ভারতের দিকে অগ্রসর হয় । ভারতে প্রথম মুসলিম আক্রমণ শুরু হয় সিন্ধুতে । সে সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মী দাহির । ...

প্রাচীন ভারতের শিল্প ও চিত্রকলা

চূড়া ও শিখরের আকৃতির বিচারে গুপ্ত যুগের পর থেকে প্রাচীন যুগের শেষ পর্যন্ত সময়ের শিল্পরীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । ইন্দো-এরিয়ান বা উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতি এবং দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়ীয় শিল্পরীতি । মহাবলী পুরম বা মামল্লপুরমের রথগুলি পল্লব শিল্পরীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ ...

প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা

গুপ্তযুগের আর্যভট্ট, বরাহমিহির, গর্গ, লাটদেব ও আর্যভট্টের শিষ্যগণ গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় মৌলিক অবদান রেখেছিলেন । পৃথিবীর আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতির কথা আর্যভট্টের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি । আর্যভট্টের লেখা ‘সুর্যসিদ্ধান্ত’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ...

প্রাচীন ভারতের সাহিত্য

প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যের স্বর্ণভান্ডার ছিল । এ ছাড়া পালি,প্রাকৃত,বাংলা,হিন্দি,তামিল প্রভৃতি ভাষাতেও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচিত হয়েছিল । বৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, স্মৃতি প্রভৃতি কালজয়ী সাহিত্য সংস্কৃত সাহিত্যকে প্রভূতভাবে প্রভাবিত করেছিল । ...