আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - দক্ষিণ ভারত

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 21:57

আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - দক্ষিণ ভারত :

দক্ষিণ ভারত (The Deccan) : উত্তর ভারতের মতো দক্ষিণ ভারতেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত । ফলে দক্ষিণ ভারতে কোনো অখন্ড সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়নি । বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত অঞ্চলকে সাধারণভাবে দক্ষিণ ভারত মনে করলেও তুঙ্গভদ্রা নদী এই অঞ্চলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে । উত্তর অঞ্চলকে দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভাগকে সুদূর দক্ষিণ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে । দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল পশ্চিম দিকের মালভূমি অঞ্চলের রাজ্যগুলি গোদাবরী ও কৃষ্ণার বদ্বীপ অঞ্চল দখল করার চেষ্টা সব সময়ই করেছে । এই অঞ্চল ছিল তাই বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধিতার মূল কারণ ।

বাতাপির চালুক্য বংশ (Chalukya Kingdom of Vatapi) : উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটকদের পতনের পর চালুক্য বংশের উদ্ভব হয় । প্রথম পুলকেশী (Pulakesin -I) ৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাতাপিপুরে বর্তমান বিজাপুরের বাদামি -তে রাজধানী স্থাপন করে বাতাপির চালুক্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী (Pulakesin II) ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন ও ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তাঁর সভাকবি রবিকীর্তি রচিত আইহোল লিপি থেকে তাঁর কথা জানতে পারা যায় । নর্মদা থেকে কাবেরী পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল । তিনি হর্ষবর্ষন ও কাঞ্চীর রাজা মহেন্দ্রবর্মনকে পরাজিত করেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পল্লবদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন এবং তাঁর রাজধানী বিধ্বস্ত হয় । এই বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর এই বংশের পতন হয় ।

রাষ্ট্রকূট বংশ (Rashtrakuta Dynasty) : চালুক্যদের পতনের পর রাষ্ট্রকূটদের উদ্ভব হয় । চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে দন্তিদূর্গ (Dantidurga) রাষ্ট্রকূট বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । ঠিক কত খ্রিস্টাব্দে দন্তিদূর্গ সিংহাসনে বসেন তা পরিষ্কার ভাবে বলা যায় না । ডঃ আর. সি. মজুমদারের মতে ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দন্তিদূর্গ দাক্ষিণাত্যের সুবিশাল অংশের অধীশ্বর হয়েছিলেন । রাষ্ট্রকূট রাজারা কনৌজের অধিকার নিয়ে পাল ও প্রতিহারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে । কিন্তু তাঁরা একাধিক বার উভয় প্রতিপক্ষকেই পরাজিত করলেও উত্তর ভারতে প্রাধান্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হন । রাষ্ট্রকূট বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন তৃতীয় গোবন্দ (Gobinda III) তৃতীয় কৃষ্ণ (Krishna III) ছিলেন এই বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা । তৃতীয় কৃষ্ণ ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।

কল্যাণীর চালুক্য বংশ (Chalukya Kingdom of Kalyani) : রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ রাজা দ্বিতীয় কর্ককে (Karka II) পরাজিত ও নিহত করে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় তৈল (Taila II) কল্যাণীর চালুক্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি কর্ণাটক, তাঞ্জোর ও মালবের রাজাকে পরাজিত করেন । চালুক্য ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চোলদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম । চালুক্য রাজাদের মধ্যে প্রথম সোমেশ্বর, দ্বিতীয় সোমেশ্বর ও ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের (Vikramaditya VI) নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে বসেন । কল্যাণীর চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য । তিনি চালুক্য বিক্রম যুগ নামে নতুন যুগের সূচনা করেন । ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজ্যবিস্তার ও শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে বহু তথ্য তাঁর সভাকবি বিলহন রচিত বিক্রামাঙ্কদেবচরিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় ।    

কাঞ্চীর পল্লব বংশ (The Pallavas of Kanchi) :

(১) সিংহবিষ্ণু (Simhavishnu) : সাতবাহন বংশের পতনের পর কৃষ্ণা থেকে পালার নদী পর্যন্ত অঞ্চলে পল্লবদের রাজ্য স্থাপিত হয় । তাদের রাজধানীর নাম ছিল কাঞ্চী । কাঞ্চিতে পল্লব বংশের উদ্ভব কবে হয়েছিল তা পরিষ্কার করে কিছু জানা যায় নি । তবে পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণুর সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল থেকে পল্লব বংশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় । সিংহবিষ্ণু প্রায় ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণুই প্রথম পল্লব সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেন । পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণু কাবেরী নদী পর্যন্ত অঞ্চলে তাঁর প্রাধান্য বিস্তার করেন । বিখ্যাত কবি ভারবি তাঁর সমসাময়িক ছিলেন ।

(২) প্রথম মহেন্দ্রবর্মন (Mahendravarman I) : সিংহবিষ্ণুর পর তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মন সিংহাসনে আরোহণ করেন । প্রথম মহেন্দ্রবর্মন ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব । প্রথম মহেন্দ্রবর্মনও শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন । তাঁর আমলে পল্লব-চালুক্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে প্রথম মহেন্দ্রবর্মন যুদ্ধে নিহত হন ।

(৩) প্রথম নরসিংহবর্মন (Narasimhavarman I) : প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মন সিংহাসনে বসেন । তিনি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তাঁর সময় পল্লব বংশ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে । তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে যুদ্ধে পরাজিত করে পল্লব বংশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন ও ‘মহামল্ল’ উপাধি ধারন করেন । তাঁর সময় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং (Hiuen Tsang) কাঞ্চির রাজসভায় কিছুকালের জন্য অবস্থান করেন । হিউয়েন সাং প্রথম নরসিংহবর্মনের রাজ্যশাসন সম্মন্ধে সুন্দর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন । গঙ্গরাজ্য, চোল, কেরল, পান্ড্য প্রভৃতি রাজ্য তাঁর অধীনস্থ হয় ।  মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলি তাঁর সময়ে নির্মিত হয় ।

(৪) অপরাজিতবর্মণ (Aparajitavarman) : অপরাজিতবর্মণ ছিলেন এই বংশের শেষ রাজা । নবম শতকের শেষের দিকে চোল রাজের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন । এই পরাজয়ের পর পল্লব বংশের পতন সম্পূর্ণ হয় । 

তাঞ্জোরের চোল বংশ (The Cholas of Tanjore) :

(১) বিজয়ালয় (Vijayalaya) ছিলেন চোল বংশের প্রতিষ্ঠাতা । বিজয়ালয় প্রথম জীবনে পল্লবদের অধীনে একজন করদ রাজা ছিলেন । নবম শতকের মধ্যভাগে তিনি তাঞ্জোরে নিজেকে স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করেন ।

(২) এরপর আদিত্য চোল, প্রথম পরান্তক (৯০৭ - ৯৫৫) ও দ্বিতীয় পরান্তকের (৯৫৭ - ৯৭৩) রাজত্বকালে চোল শক্তি সাবালকত্ব পায় । তাদের অধিকার মাদুরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।

(৩) প্রথম রাজরাজের (Rajaraja I) আমলে চোল শক্তি দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । প্রথম রাজরাজের সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে চোল বংশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় । তিনি তাঁর সময়কালে নিজেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারতের অধীশ্বরে পরিণত করেন । তিনি চেরদের (কেরল) পরাজিত করার পাশাপাশি বেঙ্গি, গঙ্গাবধি, কলিঙ্গ, সিংহল, মালদ্বীপ জয় করেন । তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দির তিনিই নির্মাণ করেন ।

(৪) রাজেন্দ্র চোল (Rajendra Chola) : রাজেন্দ্র চোল প্রথম রাজেন্দ্র নামেও পরিচিত ছিলেন । চোল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোল । তিনি ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । মাদুরা, সিংহল, আদিনগর, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল । তিনি চালুক্যদের পরাজিত করে তুঙ্গভদ্রা নদী পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল রাঢ়-বঙ্গ আক্রমণ । তিনি পাল রাজ প্রথম মহীপালকে পরাজিত করে গঙ্গইকোন্ড উপাধি গ্রহণ করেন । অবশ্য বাংলায় তাঁর আধিপত্য বেশি দিন স্থায়ী হয় নি । ভারতের বাইরে তিনি মালয়, সুমাত্রা, পেনাঙ্গ ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অভিযান পাঠান । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শৈলেন্দ্র বা শ্রীবিজয় রাজ্য তাঁর আধিপত্য স্বীকার করে । চোল নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করে ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ঔপনিবেশিক সম্রাট হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

(৫) রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যুর পর চোল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় । চালুক্যদের সঙ্গে বিবাদে তাদের শক্তি ক্ষয় হতে থাকে ও  দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি পতন সম্পূর্ণ হয় ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...