গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 03/24/2020 - 13:02

গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?

[Comment on the cultural achievements of the Gupta age (Golden age)]

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্ত রাজাদের শাসনকাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । গ্রিক ইতিহাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে যেমন পেরিক্লিসের যুগকে সুবর্ণযুগ বলা হয় তেমনই ভারত ইতিহাসে গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় । গুপ্ত যুগে ভারত ইতিহাসে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সামগ্রিক উন্নতি দেখা গিয়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে বহু ইতিহাসবিদ এই যুগকে সুবর্ণ যুগ বলে অভিহিত করেছেন । সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই যুগের সর্বাঙ্গীণ অগ্রগতির কারণ সম্পর্কে ডঃ ভিনসেন্ট স্মিথ -এর মতে, গুপ্ত রাজাদের আমলে সুবর্ণ যুগের উত্থান সম্ভব হয়েছিল বৈদেশিক সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের ফলে । কিন্তু এই অভিমত সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা যায় না । বরং বলা যায়, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল । গুপ্ত রাজারা তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভাবলে একে একে কুষাণ ও শক রাজ্যগুলি বিলুপ্ত করে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন । এভাবে উত্তর ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ঐক্য পুনঃস্থাপিত হবার ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয় ।    

দক্ষ শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা— শুধু সাম্রাজ্য বিস্তারই নয়, গুপ্ত রাজারা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যে এক সুদক্ষ ও কার্যকরী শাসনববস্থা প্রতিষ্ঠা করেন । গুপ্ত যুগে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠে । দেশে সুশাসন প্রচলিত থাকার ফলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সহজ হয়েছিল ।

কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অগ্রগতি— গুপ্ত যুগে কৃষি ছিল অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি এবং এ যুগে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল । সেচের জন্য সুদর্শন হ্রদের সংস্কার করা হয়েছিল । কৃষিকার্যে উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সেচব্যবস্থার প্রচলনের ফলে কৃষি-উৎপাদন বেড়েছিল । বস্ত্রশিল্প, লৌহশিল্প, ধাতুশিল্প, চর্মশিল্প, কাষ্ঠশিল্প-সহ বহু শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল । কৃষি ও শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গুপ্ত যুগে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল । ভৃগুকচ্ছ, কল্যাণ, উজ্জয়িনী প্রভৃতি বন্দরের মাধ্যমে জলপথে ব্রহ্মদেশ, মালয়, পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, রোম, চিন, পারস্য, আরব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে এবং স্থলপথে মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে । এর ফলে ভারতের অর্থনৈতিক মান যেমন উন্নত হয়েছিল তেমনই এই বাণিজ্য পথ ধরেই ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি বিদেশে প্রসার লাভ করেছিল । 

সামাজিক উদারতা বৃদ্ধি— গুপ্ত যুগে সমাজের উদারতা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে ভেদাভেদ হ্রাস পেয়েছিল । সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য বেশি থাকলেও বর্ণপ্রথা তেমন ভাবে কঠোর ছিল না । সেই সময় উচ্চ ও নীচ বর্ণের মানুষদের মধ্যে মেলামেশা বৃদ্ধি পায় । অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ রীতি স্মৃতিশাস্ত্রে স্বীকৃত হয় । গুপ্ত যুগে নারী ও শুদ্রদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয় । এ যুগে নারীরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারত । ফা-হিয়েন বলেছেন যে, একমাত্র চন্ডালরা সমাজে অস্পৃশ্য ছিল । তুলনামূলকভাবে সামাজিক উদারতা বৃদ্ধি সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল । গুপ্তরাজগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁরা পরধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন এবং শাসনকার্যে পরধর্মে বিশ্বাসী লোকদেরও নিযুক্ত করতেন । যেমন, সমুদ্রগুপ্তের সেনাপতি আম্রকার্দব ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেন ছিলেন বুদ্ধের উপাসক । এ যুগে ধর্ম বিরোধের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না ।  

সাহিত্যে অগ্রগতি — সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল । ড. আর. ত্রিপাঠী এই অগ্রগতিকে প্রাচীন গ্রিসের পেরিক্লিসের যুগের সঙ্গে এবং ইংল্যান্ডের এলিজাবেথের যুগের সঙ্গে তুলনা করেছেন । এ যুগের সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা । সমুদ্রগুপ্তের 'কবিরাজ' উপাধি থেকে তাঁর কবিপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর সভাকবি হরিষেণের কবিপ্রতিভার পরিচয় মেলে সংস্কৃত ভাষায় রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে । এ যুগেই বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র, যেমন — যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি, কাত্যায়ন-স্মৃতি, ব্যাস-স্মৃতি, বৃহস্পতি-স্মৃতি, দেবল-স্মৃতি, নারদ স্মৃতি প্রভৃতি রচিত হয় । কয়েকটি পুরাণ এবং রামায়ণ ও মহাভারত এই যুগে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে এক নতুন সাহিত্যের রূপ লাভ করে । যেসব বিখ্যাত পন্ডিত দার্শনিক ও শাস্ত্রকার এই যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরকৃষ্ণ, বসুবন্ধু, অসঙ্গ, গৌড়পাদ, পক্ষিলসামীন, চন্দ্রগোমিন, বৌধায়ন, দিন্নগাচার্য, ভর্তৃহরি, পাণিনি, পতঞ্জলি প্রমূখ । বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম, ভারবির কিরাতর্জুনীয়ম, ভট্টির ভট্টিকাব্য, দন্ডীর দশকুমারচরিত, বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্র, অমর সিংহের শব্দকোষ প্রভৃতি গুপ্ত যুগেই রচিত হয় । মহাকবি কালিদাস ছিলেন গুপ্ত যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক । তাঁর রচিত অভিজ্ঞানশকুন্তলম, মালবিকাগ্নিমিত্রম, মেঘদূতম্, ঋতুসংহার, কুমারসম্ভব প্রভৃতি কাব্য ও নাটক প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ।

স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় অগ্রগতি — গুপ্ত যুগে (১) স্থাপত্য, (২) ভাস্কর্য ও (৩) চিত্রকলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ লক্ষ্য করা যায় । আর. ডি. ব্যানার্জির মতে, গুপ্ত যুগে ভারতীয় শিল্পকলা দীর্ঘকালের পরাধীনতামুক্ত হয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল । এযুগের শিল্পকলার প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মথুরা, বারানসী ও পাটলিপুত্র । 

(১) স্থাপত্য — গুপ্ত যুগে পাথর কেটে বিভিন্ন বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু মন্দির তৈরি করা হয় । অজন্তা, ইলোরা, উদয়গিরির গুহামন্দিরগুলি এর প্রকৃষ্ট নিদর্শন । এই চিত্রগুলি ছিল বাস্তবতায় পরিপূর্ণ এবং বিভিন্ন শ্রেণির নরনারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি সমৃদ্ধ । ইট, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে স্থায়ী মন্দির নির্মাণের রীতি গুপ্ত যুগেই চালু হয় । গুপ্ত যুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থাপত্য-নিদর্শন হল — মণিনাগের মন্দির, কোটেশ্বর মন্দির, তিগোয়ার বিষ্ণুমন্দির, ভুমারের শিবমন্দির, কুবীরের পার্বতীমন্দির, দেওগড়ের প্রস্তর নির্মিত দশাবতার মন্দির, সাঁচি ও বুদ্ধগয়ার স্তুপ, ভিতর গাওয়ের ইষ্টক নির্মিত পিরামিড আকৃতির মন্দির ইত্যাদি । ভিতর গাওয়ের মন্দিরটির দেওয়ালগুলি অলংকার খচিত ও পৌরাণিক আখ্যানে খোদিত ।

(২) ভাস্কর্য — গুপ্ত যুগের ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন পৌরাণিক হিন্দু দেবদেবীর ও বৌদ্ধধর্মের কাহিনি । সারনাথের বৌদ্ধমূর্তিগুলি হল এই সময়কার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন  । অমরাবতী ও মথুরার ভাস্কর্য-শোভা এ যুগে পরিণত রূপ লাভ করেছিল । সারনাথের অবলোকিতেশ্বর মূর্তি, সাঁচির বোধিসত্ত্ব, মথুরার ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । বারাণসী ও উজ্জয়িনীতে বহু ভাস্কর্য-নিদর্শন রয়েছে । এ যুগের মূর্তিগুলির সৌন্দর্য্য ছিল অনুপম । মূর্তিগুলির সাবলীল অঙ্গবিন্যাস ও রেখার সুষ্পষ্টতা ছিল অপূর্ব এবং তাতে আধ্যাত্মিকতার ছাপ ছিল স্পষ্ট । ড. নীহাররঞ্জন রায় ও অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন যে, গুপ্ত যুগের শিল্পীরা অতীন্দ্রিয় শিল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং তাতে তাঁরা সফল হয়েছিলেন ।

(৩) চিত্রকলা চিত্রকলার ক্ষেত্রও গুপ্ত যুগে প্রভূত অগ্রগতি হয়েছিল । অজন্তা ও ইলোরার গুহার দেওয়ালে গুপ্ত যুগে আঁকা চিত্রকলাগুলি আজও দর্শকদের বিস্মিত করে । চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, যা কিছু মহৎ, যা কিছু ক্ষুদ্র সবই অজন্তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে । এ ছাড়া, মালবের বাঘ গুহাচিত্রের নিদর্শনগুলিও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । 'মাতা ও পুত্র', 'বোধিসত্ত্ব' চক্রপাণি', 'হরিণ চতুষ্টয়' প্রভৃতি চিত্রে বাস্তব জীবনের কাহিনী ফুটে উঠেছে । ইতিহাসবিদ ডঃ দ্বিজেন্দ্রনারায়ন ঝা মন্তব্য করেছেন যে, অজন্তার শিল্পীগন মানুষ ও পশুর প্রতিকৃতি অঙ্কনে চূড়ান্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন ।

বিজ্ঞানের অগ্রগতি — বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল । (১) চিকিৎসাবিদ্যা, (২) ধাতুশিল্প, (৩) গণিত, (৪) জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় এই অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় । গুপ্ত যুগের বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ ড. দ্বিজেন্দ্রানারায়ণ ঝা মনে করেন যে, এই যুগে আর্যভট্ট ও বরাহমিহিরের রচনায় জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান-সংক্রান্ত যে অগ্রগতি লক্ষ করা যায় তা ছিল একান্তই দেশীয় ঐতিহ্যের ফল  ।

(১) চিকিৎসাবিদ্যা — ধনন্তরি ও বাগভট্ট তাঁদের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থগুলি গুপ্ত যুগেই রচনা করেন । কেউ কেউ মনে করেন গুপ্তযুগে বাগভট্ট নামে দু-জন ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁরা পৃথক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন । প্রবীন বাগভট্ট অষ্টাঙ্গসংগ্রহ এবং নবীন বাগভট্ট অষ্টাঙ্গ-হৃদয় সংহিতা রচনা করেন । পশুচিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থও এই সময় রচিত হয় । হস্ত্যায়ুর্বেদ নামক গ্রন্থটি হাতির চিকিৎসার জন্য এবং অশ্বশাস্ত্র নামে গ্রন্থটি ঘোড়ার চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থ ছিল । চিকিৎসক সুশ্রুত-কে কেউ কেউ কুষাণ যুগের মানুষ বলে মনে করলেও অনেকে তাঁকে গুপ্ত যুগের মানুষ বলে মনে করেন । তাঁর রচিত সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাশাত্রের এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ।   

(২) ধাতুবিদ্যা — ধাতুবিদ্যায় গুপ্ত যুগে বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল । এযুগে রচিত অমরকোষ গ্রন্থে খনিজ আকর, কাঁচা ও পাকা সোনা এবং লোহা সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় । এই গ্রন্থে রুপো, তামা, টিন প্রভৃতি বিভিন্ন ধাতুর উল্লেখ রয়েছে । এ যুগে নির্মিত দিল্লির নিকটবর্তী মেহেরৌলী গ্রামের লৌহস্তম্ভটিতে আজও কোনো মরচে পড়েনি । নালন্দায় প্রাপ্ত বুদ্ধের তাম্রমূর্তি, বিভিন্ন স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রভৃতি এ যগের ধাতুশিল্পের অগ্রগতির পরিচয় দেয় ।

(৩) গণিতশাস্ত্র — গণিতের বিভিন্ন শাখায় গুপ্ত যুগে অভূতপূর্ব চর্চা হয়েছিল । আর্যভট্ট রচিত 'আর্যভট্টীয়' নামক গ্রন্থে বীজগনিতের বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ, বৃত্তের জ্যামিতিক ধর্ম প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে ।  ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা ও শূন্যের ব্যবহার গুপ্ত যুগে ভারতেই প্রচলিত হয় । পিথাগোরাসের 'থিওরেম' এবং ত্রিকোণমিতির 'সাইন', 'কোসাইন' প্রভৃতি গাণিতিক ধারণার সঙ্গেও গুপ্ত যুগে ভারতীয়রা পরিচিত ছিল । দশমিকের ব্যবহার সর্বপ্রথম আর্যভট্ট এই যুগেই শুরু করেন । এ যুগের গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপ্ত পাটি গণিত ও বীজ গণিতের বেশ কিছু জটিল সমস্যার সমধান করেন ।

(৪) জ্যোতির্বিদ্যা — জ্যোতির্বিদ্যায় গুপ্ত যুগে প্রভূত উন্নতি হয়েছিল । আর্যভট্ট ছিলেন এই যুগেরই অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী । তিনি সূর্য-সিদ্ধান্ত, আর্যভট্টীয়ম, 'দশগীতিকা সূত্র' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন । তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং বছরে ৩৬৫ দিন হয় । তিনি আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণও আবিষ্কার করেন । বৃহৎ-সংহিতা ও পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থের রচয়িতা বরাহমিহির জ্যোতির্বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন । ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর ব্রহ্মসিদ্ধান্ত-এ পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের ইঙ্গিত দেন ।

হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান — মৌর্যযুগে হিন্দুধর্ম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও গুপ্ত যুগে হিন্দু ধর্মে নবপ্রাণের সঞ্চার হয়েছিল । তাই প্রখ্যাত জার্মান ইতিহাসবিদ ও ভারত তাত্ত্বিক ম্যাক্সমুলার গুপ্ত যুগকে 'হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের যুগ' বলে চিহ্নিত করেন । বৈদিক যাগযজ্ঞের গুরুত্ব গুপ্ত যুগে হ্রাস পায় । এ যুগে ভক্তিধর্মের বিকাশ ঘটে এবং মূর্তিপূজা ও তন্ত্রধর্মের প্রচলন হয় । গুপ্ত যুগে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতার গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং শিব, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক, দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী প্রভৃতি দেবদেবীর উপাসনা শুরু হয় । গুপ্ত রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী হলেও তাঁরা পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন । সমুদ্রগুপ্তের সেনাপতি আম্রকার্দব ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেন ছিলেন বুদ্ধের উপাসক ।

মূল্যায়ন — বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও উৎকর্ষের জন্য অনেকে গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলে অভিহিত করেছেন । তবে ডি.এন.ঝা, আর.এন.শর্মা, জি.জি.কোশাম্বী প্রমুখ এই যুগকে সুবর্ণ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করার বিরোধিতাও করেছেন । তাঁরা এই যুগের বিভিন্ন পশ্চাদগামিতা ও ত্রুটি তুলে ধরেছেন । যেমন —

(১) রোমিলা থাপার মনে করেন যে, গুপ্ত যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে যা কিছু অগ্রগতি ঘটেছিল তা সমাজের উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । সমাজের নিম্নশ্রেণির সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ ছিল না ।

(২) গুপ্ত যুগের শিল্পকলার সঙ্গেও সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তা ছিল উচ্চ শ্রেণির মানুষের চর্চার বিষয় ।

(৩) গুপ্ত যুগে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছিল তাতে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয়নি । কৃষি-অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল ।

(৪) এই যুগে অনেক প্রাচীন শহর ধ্বংস হয় এবং ভূমিদাস প্রথার উদ্ভবের ফলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে ।

(৫) এই যুগে নারীদের মর্যাদা হ্রাস পায় । বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা ব্যাপক আকার ধারণ করে ।

(৬) প্রদীপের নিচেই যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি গুপ্ত যুগে শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জীবন ছিল দুঃখ-দুর্দশায় ভরা । তাই ড. রামশরণ শর্মা বলেছেন যে, সাহিত্য, ধর্ম ও শিল্পের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলে অভিহিত করলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচারে এই যুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলা যায় না । ড. ডি. এন. ঝা -র মত অনুযায়ী গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলা আসলে 'অতিকথন' ।

****

Comments

Related Items

নেহেরু রিপোর্ট ও এর মূল্যায়ন

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মৌতে সর্বদলীয় সন্মেলনের পূর্ণ অধিবেশনে নেহেরু কমিটির প্রধান মতিলাল নেহেরু সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন । এই খসড়া সংবিধানই নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত । এই রিপোর্টে অবিলম্বে ভারতকে স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস-এর মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয় ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ

বিদ্রোহের কারণগুলি পর্যালোচনা করলে কারণগুলিকে মোটামুটি কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । যথা- (ক) অর্থনৈতিক কারণ, (খ) সামাজিক কারণ, (গ) রাজনৈতিক কারণ, (ঘ) ধর্মীয় কারণ এবং (ঙ) সামরিক কারণ ।