দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৫

Submitted by administrator on Fri, 04/27/2012 - 00:40

মেরামত করতে। শর্মিলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। বাষ্পাকুলকণ্ঠে বললে, “গাড়ি তুমি নিজে হাঁকাতে পারবে না।”

শশাঙ্ক হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললে, “পরের হাতের আপদও একই জাতের দুশমন।”

একদিন কোন্ মেরামতের কাজ তদন্ত করতে গিয়ে জুতো ফুঁড়ে পায়ে ফুটল ভাঙা প্যাকবাক্সর পেরেক, হাঁসপাতালে গিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ধনুষ্টংকারের টিকে নিলে, সেদিন কান্নাকাটি করলে শর্মিলা; বললে, “কিছুদিন থাকো শুয়ে।”

শশাঙ্ক অত্যন্ত সংক্ষেপে বললে, “কাজ।” এর চেয়ে বাক্য আর সংক্ষেপ করা যায় না।

শর্মিলা বললে, “কিন্তু”—এবার বিনা বাক্যেই ব্যাণ্ডেজসুদ্ধ চলে গেল কাজে।

জোর খাটাতে আর সাহস হয় না। আপন ক্ষেত্রে পুরুষের জোর দেখা দিয়েছে। যুক্তিতর্ক-কাকুতিমিনতির বাইরে একটিমাত্র কথা—‘কাজ আছে।’ শর্মিলা অকারণে উদ্‌বিগ্ন হয়ে বসে থাকে। দেরি হলেই ভাবে মোটরে বিপদ ঘটেছে। রোদ্‌দুর লাগিয়ে স্বামীর মুখ যখন দেখে রক্তবর্ণ, মনে করে নিশ্চয় ইনফ্লুয়েঞ্জা। ভয়ে ভয়ে আভাস দেয় ডাক্তারের—স্বামীর ভাবখানা দেখে ঐখানেই থেমে যায়। মন খুলে উদ্‌বেগ প্রকাশ করতেও আজকাল ভরসা হয় না।

শশাঙ্ক দেখতে দেখতে রোদে-পোড়া খট্‌খটে হয়ে উঠেছে। খাটো আঁট কাপড়, খাটো আঁট অবকাশ, চালচলন দ্রুত, কথাবার্তা স্ফুলিঙ্গের মতো সংক্ষিপ্ত। শর্মিলার সেবা এই দ্রুত লয়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে চেষ্টা করে। স্টোভের কাছে কিছু খাবার সর্বদাই গরম রাখতে হয়, কখন স্বামী হঠাৎ অসময়ে বলে বসে, ‘চললুম, ফিরতে দেরি হবে।’ মোটরগাড়িতে গোছানো থাকে সোডাওআটার এবং ছোটো টিনের বাক্সে শুকনোজাতের খাবার। একটা ওডিকোলনের শিশি বিশেষ দৃষ্টিগোচররূপেই রাখা থাকে, যদি মাথা ধরে। গাড়ি ফিরে এলে পরীক্ষা করে দেখে কোনোটাই ব্যবহার করা হয় নি। মন খারাপ হয়ে যায়। সাফ কাপড় শোবার ঘরে প্রত্যহই সুপ্রকাশ্যভাবে ভাঁজ করা, তৎসত্ত্বেও অন্তত সপ্তাহে চার দিন কাপড় ছাড়বার অবকাশ থাকে না। ঘরকন্নার পরামর্শ খুবই খাটো করে আনতে হয়েছে, জরুরি টেলিগ্রামের ঠোকর-মারা ভাষার ধরনে, সেও চলতে চলতে পিছু ডাকতে ডাকতে, বলতে বলতে ‘ওগো শুনে যাও কথাটা।’ ওদের ব্যাবসার মধ্যে শর্মিলার যে একটুখানি যোগ ছিল তাও গেল কেটে, ওর টাকাটা এসেছে সুদে আসলে শোধ হয়ে। সুদও দিয়েছে মাপজোখ-করা হিসেবে, দস্তুরমত রসিদ নিয়ে। শর্মিলা বলে, ‘বাস রে, ভালোবাসাতেও পুরুষ আপনাকে সবটা মেলাতে পারে না। একটা জায়গা ফাঁকা রাখে, সেইখানটাতে ওদের পৌরুষের অভিমান।’

লাভের টাকা থেকে শশাঙ্ক মনের মতো বাড়ি খাড়া করেছে ভবানীপুরে। ওর শখের জিনিস। স্বাস্থ্য আরাম শৃঙ্খলার নতুন নতুন প্ল্যান আসছে মাথায়। শর্মিলাকে আশ্চর্য করবার চেষ্টা। শর্মিলাও বিধিমত আশ্চর্য হতে ত্রুটি করে না। এঞ্জিনিয়ার একটা কাপড়-কাচা কলের পত্তন করেছে, শর্মিলা সেটাকে ঘুরে ফিরে দেখে খুব তারিফ করলে। মনে মনে বললে, ‘কাপড় আজও যেমন ধোবার বাড়ি যাচ্ছে কালও তেমনি যাবে। ময়লা কাপড়ের গর্দভবাহনকে বুঝে নিয়েছি, তার বিজ্ঞানবাহনকে বুঝি নে।’ আলুর খোসা ছাড়াবার যন্ত্রটা দেখে তাক লেগে গেল, বললে, ‘আলুর দম তৈরি করবার বারো-আনা দুঃখ যাবে কেটে।’ পরে শোনা গেছে সেটা ফুটো ডেকচি ভাঙা কাৎলি প্রভৃতির সঙ্গে এক বিস্মৃতিশয্যায় নৈর্ষ্কম্য লাভ করেছে।

বাড়িটা যখন শেষ হয়ে গেল তখন এই স্থাবর পদার্থটার প্রতি শর্মিলার রুদ্ধ স্নেহের উদ্যম ছাড়া পেলে। সুবিধা এই যে, ইঁটকাঠের দেহটাতে ধৈর্য অটল। গোছানো-গাছানো সাজানো-গোজানোর মহোদ্যমে দুই-দুইজন বেহারা হাঁপিয়ে উঠল, একজন দিয়ে গেল জবাব। ঘরগুলোর গৃহসজ্জা চলছে শশাঙ্ককে লক্ষ্য করে। বৈঠকখানাঘরে সে আজকাল প্রায়ই বসে না, তবু তারই ক্লান্ত মেরুদণ্ডের উদ্দেশে কুশন নিবেদন করা হচ্ছে নানা ফ্যাশনের; ফুলদানি একটা-আধটা নয়, টিপায়ে টেবিলে ঝালরওআলা ফুলকাটা আবরণ। শোবার ঘরে দিনের বেলায় শশাঙ্কর সমাগম আজকাল বন্ধ, কেননা তার আধুনিক পঞ্জিকায় রবিবারটা সোমবারেরই যমজ ভাই। অন্য ছুটিতে কাজ যখন বন্ধ তখনো ছুটোছাটা কাজ কোথা থেকে সে খুঁজে বের করে, আপিস-ঘরে গিয়ে প্ল্যান আঁকবার

Related Items

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-১০

“নতুন নামটা শুনি।”

“বিদ্যুৎলতা। নীরদের পছন্দ হবে! ল্যাবরেটরিতে ঐ পদার্থটার সঙ্গে পরিচয় আছে, এবার ঘরে পড়বে বাঁধা।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৯

  কিন্তু ব্যবহারে করে নি যে তার কারণ, এ ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবহারটাই ওর স্বভাবে নেই। ও আলোচনা করতে পারে, আলাপ করতে জানে না। যৌবনের উত্তাপ ওর মধ্যে যদি-বা থাকে, তার আলোটা নেই। এইজন্যেই, যে-সব যুবকের মধ্যে যৌবনটা যথেষ্ট প্রকাশমান তাদের অবজ্ঞা করেই ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। এই-সকল কারণে ওকে ঊর্মির উমেদার-শ্রেণীতে গণ্য করতে কেউ সাহস করে নি। অথচ সেই প্রতীয়মান নিরাসক্তিই বর্তমান কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওর ‘পরে ঊর্মির শ্রদ্ধাকে সম্ভ্রমের সীমায় টেনে এনেছিল।

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৮

ঊর্মির অকস্মাৎ মনে হল, এ মানুষটার প্রতিভা অসামান্য। বাবাকে বললে, “দেখো তো বাবা, অল্প বয়স অথচ নিজের পরে কী দৃঢ় বিশ্বাস আর অতবড়ো হাড়-চওড়া বিলিতি ডাক্তারের মতের বিরুদ্ধে নিজের মতকে নিঃসংশয়ে প্রচার করতে পারে এমন অসংকুচিত সাহস।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৬

তেলা কাগজ কিম্বা খাতাপত্র নিয়ে বসে। তবু সাবেক কালের নিয়ম চলছে। মোটা গদিওআলা সোফার সামনে প্রস্তুত থাকে পশমের চটিজোড়া। সেখানে পানের বাটায় আগেকার মতোই পান থাকে সাজা, আলনায় থাকে পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি। আপিস-ঘরটাতে হস্তক্ষেপ করতে সাহসের দরকার, তবু শশাঙ্কের অনুপস্থিতি-কালে ঝাড়ন হাতে শর্মি

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৪

“সে কি হয়। ও টাকা যে তোমার।” বলে শশাঙ্ক উঠে পড়ল। বাইরে লোক বসে আছে।

শর্মিলা স্বামীর কাপড় টেনে বসিয়ে বললে, “আমিও যে তোমারই।” তার পর বললে, “বের করো তোমার জেব থেকে ফাউণ্টেন্‌পেন, এই নাও চিঠির কাগজ, লেখো রেজিগ্‌নেশন-পত্র। সেটা ডাকে রওনা না করে আমার শান্তি নেই।”